শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ধোঁয়াহীন তামাক পণ্যে আক্রান্তঝুঁকি বাড়ছে

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ০৬ মে ২০২২, ০৯:৩৭ পিএম

শেয়ার করুন:

ধোঁয়াহীন তামাক পণ্যে আক্রান্তঝুঁকি বাড়ছে
ছবি: ঢাকা মেইল

দেশে তামাকবিরোধী আইন রয়েছে। কিন্তু সে আইন কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে? ২০১৩ সালে তামাক আইন করা হলেও এখনও বন্ধ হয়নি তামাকের ব্যবহার। আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো নানা ধরনের প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ‌তাতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে শিশু-কিশোররা। দেশে আইন থাকার পরও কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না তামাকের ব্যবহার? আইনের সমস্যা ও জটিলতাগুলো কোথায় না কি সংশোধন প্রয়োজন? এসব বিষয় নিয়ে চার পর্বের অনুসন্ধানী সিরিজ প্রতিবেদন করেছেন ঢাকা মেইলের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মোস্তফা ইমরুল কায়েস। এসব প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তামাক আইনের জটিলতা, সমস্যা ও সমাধানের কথা। আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।

প্রায় ৬০ বছর ধরে পানের সাথে জর্দা খান মরিয়ম বিবি। বয়স ৮০ ছাড়িয়েছে। পানের জর্দা না হলে তার একবেলা চলে না। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আপনি পানের সঙ্গে নিয়মিত জর্দা কেন খান, আর এটি যে ক্ষতিকর বিষয়টি জানেন কি না? মরিয়ম বিবির এক কথার উত্তর- না। অর্থাৎ তিনি তামাক পাতার তৈরি জর্দা যে শরীরের জন্য ক্ষতিকর বিষয়টি জানেনই না।


বিজ্ঞাপন


উত্তরের একটি জেলার এই বাসিন্দা মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ১৪ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। বিয়ের সাত বছর পর তিনি পান খাওয়া শুরু করেন। কালের বিবর্তনে বাজারে বিভিন্ন নাম ও স্বাদের জর্দা এসেছে। প্রত্যেকটি জর্দাই তিনি খেয়েছেন। তবে পানের সঙ্গে জর্দা খাওয়ার কারণে ক্যান্সার, হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্টের মতো রোগ তৈরি হয় এসব বিষয় একেবারেই জানতেন না তিনি।

পানের সঙ্গে জর্দা খাওয়া যে ক্ষতিকর এই নারীর মতোই জানেন না রাজবাড়ীর সদর উপজেলার আলাদিয়া গ্রামের বাসিন্দা উজ্জ্বল শেখ। তিনি জানালেন, দুই বছর আগেও পানের সঙ্গে নিয়মিত জর্দা খেতেন। কিন্তু মাথা ঘোরা ও পেটে গ্যাসের সমস্যা হওয়ার কারণে এখন পানের সঙ্গে কালোজিরা খান।

অন্যদিকে নীলফামারীর সদর উপজেলার বড় সংগলসি গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম। পড়ালেখা বেশি দূর করতে পারেননি। অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে তার সংসার চলে। নেশা বলতে একমাত্র গুল ব্যবহার করেন। তামাক পাতায় তৈরি পাউডারের এই উপকরণটি প্রতিদিন অন্তত চারবেলা লাগে তার।‌ গুল ব্যবহার যে ক্ষতিকর বিষয়টি কখনও কারও কাছে শুনেননি তিনি। ফোনে কথা হচ্ছিল রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। ফোনের এপাশ থেকে কথাগুলো শোনার পর বেশ অবাক হন তিনি।

বাংলাদেশে ধোঁয়াহীন তামাক, জর্দা ও গুল ব্যবহারকারীর অধিকাংশ মানুষ জানেনই না এই পণ্যটি ব্যবহারের পর তারা কি কি ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। ধোঁয়াহীন তামাকপণ্য যে ক্ষতিকর ব্যবহারকারীর অধিকাংশের অজানা।

শুধু কি স্বল্পশিক্ষিত লোকের বিষয়টি অজানা? বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও পানের সঙ্গে নিয়মিত জর্দা খান। তবে এই শ্রেণির মানুষদের গুল ব্যবহারকারীর সংখ্যা কম।‌ অন্যদিকে কম পড়ালেখা জানা মানুষের মধ্যে জর্দা ও গুল ব্যবহার করার প্রবণতা বেশি।

গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা বেশকিছু মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে। বিশেষ করে স্বল্প শিক্ষিত মানুষেরা জানিয়েছেন, জর্দা ও গুল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিষয়টি তাদের জানা নেই। অন্যদিকে শিক্ষিত ব্যক্তিরা জানিয়েছে, এসব পণ্য স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তারা বিষয়টি জানেন। কিন্তু পানের সঙ্গে জর্দা খাওয়ার নেশা হওয়ায় তা আর ছাড়তে পারছেন না।

দুইভাবে তামাক গ্রহণ করা হয়। ধোঁয়ার মাধ্যমে ও গুল, জর্দা, সাদাপাতা হিসেবে। সমাজে ধোঁয়াহীন তামাক পণ্য দেশে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি ও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়াচ্ছে। ফলে এই পণ্য নিষিদ্ধ না করা গেলে কোনভাবেই আক্রান্ত কমানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে ধোঁয়াহীন তামাকের মধ্যে জর্দা খুব সহজেই মেলে। বিশেষ করে পান দোকানগুলোতে পানের খিলি কিনলেই জর্দা ফ্রি দেন দোকানিরা। ফলে অধিকাংশ পুরুষ মানুষকে এই জর্দা কিনতে হয় না। আর নারীরা পানের সঙ্গে জর্দা খাওয়ার জন্য জর্দার কৌটো কিনে থাকেন। অন্যদিকে যারা গুলের ব্যবহার করেন তাদের অধিকাংশকেই পণ্যটি কিনতে হয়। গুল ব্যবহারকারী অধিকাংশ লোকজন স্বল্পশিক্ষিত।‌

কথা হচ্ছিল আঁটিবাজার এলাকার পানের দোকানদার লিটনের সাথে। তিনি জানালেন, প্রতিদিন অন্তত এক হাজার পিস পানের খিলি বিক্রি করেন তিনি। তারমধ্যে ৯৯ জন ক্রেতাই তার কাছে পানির সঙ্গে জর্দা চান। ফলে তিনিও বাধ্য হয়ে পানের সঙ্গে জর্দা মিশিয়ে তাদের কাছে বিক্রি করেন।

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির গবেষণায় (২০১৮) দেখা গেছে, দেশের ত্রিশোর্ধ্ব (৩০+) জনগোষ্ঠীর ৯ দশমিক ১ শতাংশ তামাক ব্যবহারের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের রোগ ইত্যাদিতে আক্রান্ত। এছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বছরে প্রায় ৬১ হাজার শিশু ধূমপান না করেও তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

ধূমপানের জন্য স্বাস্থ্যখাতে সরকারের ব্যয় হয় ১১ হাজার কোটি টাকা। কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে রাজস্ব আসে হয়তো দুই বা তিন হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে সরকারের নিট ব্যয় আট হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সমাজে ধূমপান না থাকলে সরকারের আট হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। বাংলাদেশে সরকারের লাখো-কোটি টাকা বাজেটের সামনে দুই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব কোনো অর্থই হতে পারে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুল‌ ও জর্দা খুচরা বিক্রি করা হলে শিশু-কিশোর ও তরুণরা খুব সহজে এবং অল্প খরচে এসব তামাকপণ্য ক্রয়ের সুযোগ পায়। সেই সঙ্গে এদের মধ্যে তামাকের ব্যবহারের উৎসাহ দেখা দেয়, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য খোলা অবস্থায় বাজারজাতকরণের সুযোগ থাকলে এগুলোর উৎপাদন খরচ কমে যায় এবং কর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। ফলে সহজলভ্যতা বৃদ্ধি পায় এবং স্বল্প আয়ের মানুষ ও নারীরা এসব পণ্য ব্যবহারে বেশি উৎসাহিত হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের তথ্যমতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিয়ানমার ও নেপালের পরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে কম দামে ধোঁয়াহীন তামাক পণ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য এখানে আরও সস্তা। ধোঁয়াহীন এসব তামাকপণ্যের খোলা বাজারে বিক্রির হাওয়াই খুব সহজে আসক্ত ব্যক্তিরা কিনতে পারেন। বাংলাদেশের ধোঁয়াহীন তামাক পণ্য ক্রয়কারী সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

এ জন্য এরই মধ্যে বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ সংশোধন করে বিড়ি-সিগারেটের সিঙ্গেল স্টিক বা খুচরা শলাকা এবং প্যাকেট ব্যতীত বা খোলা ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য বিক্রয় নিষিদ্ধ দাবি জানিয়েছেন তামাক বিরোধী সংগঠনগুলোর সংশ্লিষ্টরা।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ (জরীপ-২০১৭) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী দুই কোটি ২০ লাখ (২০ দশমিক ৬ শতাংশ) এবং ধূমপায়ী এক কোটি ৯২ লাখ (১৮ শতাংশ)। বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯ দশমিক ২ শতাংশ (২০১৪), যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর এক লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে।  ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

এবিএম জুবায়ের বলেন, আমরা চাই যে এটার সহজলভ্যতা কমিয়ে আনা। জর্দা ও গুল খুচরা বিক্রি বন্ধ করা। তাহলে সেবনকারীরা নিরুৎসাহিত হবে। দাম বেশি হলে তারা আর কিনতে চাইবে না। পাশাপাশি প্যাকেটের বিজ্ঞাপনের সাইজও বড় করতে হবে।

ধোঁয়াহীন তামাক পণ্যের কুফল নিয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের রোগ তত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান প্রফেসর সোহেল রেজা চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, দুই ধরনের তামাক ব্যবহার করা হয়। ধোঁয়াবিহীন হচ্ছে, সাদা পাতা, তামাক, গুল, জর্দা এছাড়াও আরও অনেককিছু আছে। জর্দা ও সাদা পাতার অনেকগুলো ক্ষতিকর দিক আছে। বিশেষ করে মুখগহ্বর ও গল নালীর ক্যান্সার এই জর্দা ও সাদা পাতা এবং গুল খাওয়ার ফলেই হচ্ছে। এগুলো অনেকদিন ব্যবহারের ফলে আমাদের মুখে থাকা ঝিল্লি ও মুখ গহ্বরে অনেক পরিবর্তন আসে। ফলে দ্রুত ক্যান্সার হয়।

প্রফেসর সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, পৃথিবীর অনেক মুখ গহ্বরে ক্যান্সার খুব কম হয়। সেই দেশগুলোতে এই জায়গায় ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা খুব কম। কিন্তু বাংলাদেশে ক্যান্সার হওয়ার নেপথ্যের মধ্যে তিন নম্বর কারণ এই জর্দা, সাদা পাতা ও গুল খাওয়া। এছাড়াও তামাক পাতা, জর্দা ও গুল ব্যবহারের সঙ্গে হৃদ রোগের সম্পর্ক আছে।

জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের রোগ তত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের এই কর্মকর্তা বলেন, অনেক দেশেই গবেষণায় এসেছে, ইউরোপের কয়েকটি দেশ ও ভারতে গবেষণা করে দেখা গেছে যারা এসব ব্যবহার করেন তাদের হৃদ রোগের সম্ভাবনাটা অনেকাংশে বেড়ে যায়। জর্দা, গুল ও সাদা পাতা ব্যবহারে ক্যান্সার ও হৃদরোগ বেশি হয়। এটাতে নিকোটিন আছে। ফলে এটা ছেড়ে আসা কঠিন হয়। গর্ভাবস্থায় যদি কেউ এসব গ্রহণ করে হবে পেটের বাচ্চার বৃদ্ধি সঠিকভাবে হয় না।

সার্বিক বিষয়ে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সদস্য সচিব ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আলী হোসেন খন্দকার বলেন, ধোঁয়াহীন তামাক জাতীয় পণ্য বিক্রি ও উৎপাদন নিষিদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন সংগঠন ছাড়াও মন্ত্রী-এমপিদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তার মানে দেশের অনেকেই চায় ধোঁয়াহীন এই তামাক পণ্য নিষিদ্ধ হোক। আমরা চাই। সামনে সংশোধিত আইনে এই বিষয়টিও অন্য আইন তৈরি ও সংশোধনীর পাশাপাশি প্রাধান্য পাবে।

এমআইকে/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর