শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ঢাকা

বডি বিল্ডার ফারুকের মৃত্যু

কার বক্তব্য সঠিক, পুলিশ না কি পরিবারের

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:২৬ পিএম

শেয়ার করুন:

কার বক্তব্য সঠিক, পুলিশ না কি পরিবারের
ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর বংশালে ফাঁড়িতে নির্যাতনে ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ খ্যাত বডি বিল্ডার ফারুক হোসেনের মৃত্যু নিয়ে দুই ধরনের বক্তব্য এসেছে। ফারুকের পরিবারের দাবি, আটকের পর মাদক দিয়ে ফারুকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য টাকাও দাবি করেছিল পুলিশ। এছাড়া ফারুককে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে তার স্ত্রী ইমা আক্তার হ্যাপীকে কুপ্রস্তাব দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন হ্যাপী। তবে ফারুকের স্ত্রীর দাবি অস্বীকার করেছে পুলিশ। বাহিনীটির দাবি, ফারুক মাদকসহ আটক হয়েছেন। তাকে ছেড়ে দেওয়া বাবদ টাকা চাওয়া হয়নি। আর তার স্ত্রীকে কুপ্রস্তাব দেওয়ার মতো ঘটনাটিও মিথ্যা।

ফারুকের পরিবার জানায়, গত মাসের ১২ জানুয়ারি বডি বিল্ডার্স ফারুককে আটক করা হয়৷ পরদিন আড়াইশ গ্রাম গাঁজা রাখার মামলায় আদালতে পাঠানো হলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।


বিজ্ঞাপন


পরদিন রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে কোনো এক ব্যক্তি কল করে তার স্ত্রীকে জানান, ফারুকের লাশ মর্গে পড়ে আছে। তারা যেনো এসে নিয়ে যায়। পরে মরদেহ বুঝে নিতে গেলে মর্গে কোনো পুলিশ সদস্যকে পাননি বলে দাবি করেন তার স্ত্রী। পুলিশের নির্যাতনে ফারুকের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তার স্ত্রী। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবাদ পাঠানো হয়। পুলিশ থানা হাজতের ভিডিও সরবরাহ করে। সেই ফুটেজগুলোর অধিকাংশতেই ফারুককে সুস্থ দেখা গেছে।

আরও পড়ুন

বডি বিল্ডার ফারুকের মৃত্যুর বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে

পরে এসব ভিডিও নিয়ে কথা বলেন হ্যাপী আক্তার। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘পুলিশ যেসব ভিডিও প্রচারের জন্য গণমাধ্যমে সরবরাহ করেছে সেগুলো তাদের রক্ষার জন্য। কিন্তু গ্রেফতারের খবর পেয়ে তিনি ছেলেকে নিয়ে কায়েতটুলী পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে স্বামীকে ছাড়াতে অনুরোধ করেন। এমনকি তার ছেলে এক পুলিশ সদস্যের পা ধরে বাবাকে ছাড়ার অনুরোধ করেন। এসব ভিডিও পুলিশ কেন সরবরাহ করেনি?’

যা বলছে ডিএমপি


বিজ্ঞাপন


ঢাকা মহানগর পুলিশ বলছে, ১২ জানুয়ারি বংশাল থানার নাজিমউদ্দিন রোডে নিয়মিত চেকপোস্টে তল্লাশির সময় ফারুক হোসেনকে ২৫০ গ্রাম গাঁজাসহ আটক করা হয়। তাকে থানায় নেওয়ার জন্য গাড়ি আসতে দেরি হওয়ায় কায়েতটুলী ফাঁড়িতে নিয়ে বসিয়ে রাখা হয়।

ফাঁড়ির সামনের আগামাছি লেনের ৫০/১ বাড়িতে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার চিত্র তুলে ধরে ডিএমপি জানায়, ১২ জানুয়ারি রাত ৯টা ২২ মিনিট ২০ সেকেন্ডে এসআই ইমদাদুল বাইকে পুলিশ ফাঁড়ি থেকে বের হন। অন্যদিকে আসামির স্ত্রী ইমা আক্তার ফাঁড়িতে প্রবেশ করেন রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ৪০ সেকেন্ডে। ইমা ফাঁড়ি থেকে বের হন রাত ১০টা ২৫ মিনিটে ১০ সেকেন্ডে। পরে এসআই ইমদাদুল ফাঁড়িতে প্রবেশ করেন রাত ১০টা ২৮ মিনিটে। সুতরাং এসআই ইমদাদুল হকের সঙ্গে আসামির স্ত্রীর দেখা হয়নি।

পুলিশের এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ফারুকের স্ত্রী ইমা আক্তার হ্যাপী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পুলিশ কেন থানার ভেতরের ভিডিও দেখাবে? পুলিশ ফাঁড়ির ভেতরে আমার দুই বছরের ছেলে যে তার বাবাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য পুলিশের পা ধরেছিল সেটা দেখাতে বলেন। তাদের বলেন আমাদের ফাঁড়ির ভেতরের ফুটেজগুলো দেন?’

ফারুকের স্ত্রী বলেন, ‘আমার স্বামী সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বডিগার্ড ছিলেন। উনি কখনো নেশাই করতেন না। সে গাঁজা বিক্রিও করে না, খায়ও না। এসবের সঙ্গে সে জড়িতও না। ওর নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে, মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসাইছে। টাকা খাইতে না পাইরা তারা আমার স্বামীকে নির্যাতন কইরা মাইরা ফালাইছে। ওরা টাকা খাওয়ার জন্যই এসব সাজাইছে। তারা প্রথমে আমার কাছে এক লাখ দাবি করছে। যখন তাদের পা ধইরা কান্নাকাটি করছি তখন ৫০ হাজার টাকা দাবি করছে। এসআই মাসুদ রানা, এমদাদুল হক ও বুলবুল এ টাকা চেয়েছে৷ মানুষ কতটা খারাপ হলে টাকার জন্য খারাপ প্রস্তাব দিতে পারে। তাদেরকে ভেতরের ফুটেজ দিতে কন। তারা কেন বাইরের ফুটেজ দেবে?

faruk-2.jpg
থানার ভেতরে শুয়ে আছেন বডি বিল্ডার ফারুক

নির্যাতনে ফারুকের মৃত্যু হয়েছে দাবি করে হ্যাপী আরও বলেন, ‘আমার স্বামীকে ধরেছে ১২ জানুয়ারি। একদিন থানায় ছিল৷ পরদিন আদালতে তুলেছে। সেদিনই তার সঙ্গে শেষ কথা হইছে। একজন সুস্থ মানুষকে ধরে নিয়ে গেল কিন্তু সে একদিন পরেই মারা গেল এটা কী বিশ্বাসযোগ্য! আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। যে আমার স্বামীকে মেরেছে আমি তাদের বিচার চাই।’

ফারুকের স্ত্রী আরও বলেন, ‘ফারুকের মৃত্যুর খবর আমি ঢাকা মেডিকেলের মর্গ থেকে পাই। মরদেহ মর্গে দেওয়ার সময় কোনো ঠিকানাও দেয়নি পুলিশ।’

মরদেহ নেওয়ার সময় কোনো পুলিশ ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা যদি একবার জানাতো আমার স্বামী অসুস্থ তাহলে আমি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু তারা আমাকে সেই সুযোগটাও দেয়নি। সে কোনো অসুস্থ ছিল না৷ শারীরিকভাবে ফিট ছিল। সে ভালো একটা অফিসে চাকরি করে। তাহলে কী করে নেশা করে।’

ফারুকের শরীরের আঘাতের চিহ্ন ছিল দাবি করে হ্যাপী বলেন, ‘যখন মর্গে লাশ নিতে যাই দেখি ওর গলায় ও পিঠে মাইরের দাগ ছিল। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে দাগ ছিল৷ পুলিশ ফাঁড়িতে তো পুলিশে আমার স্বামীকে পিটাইছে আমার সামনে আমিই সাক্ষী। তারা যে তারা মারধর করে মেরে ফেলবে তাতো আগে জানতাম না। আর যারা ধরে নিয়ে গেছে তারা ছাড়া আর কে মারবে। আমার স্বামী মারা যাওয়ার আগে আমারে বইলা গ্যাছে ওরা আমারে মাইরা ফেলবো। তুমি বিচার চাইতে কোর্টে যাইবা৷ সেজন্য আমি আর থানায় যাই নাই, কোর্টেই গেছি। একজন মানুষ ক্যান কইব ওরা আমারে মাইরা ফেলব! তারা আমার স্বামীর হাত পা ভাইঙা দিতো তারপরও সে আমার কাছে থাকতো। আমার বাচ্চারা ওর বাবার আদর পাইতো।’

এলাকাবাসীর ভাষ্য

ফারুকের বাসার গলিতে কথা হয় তার এক প্রতিবেশীর সঙ্গে। নাম বলতে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, মাদক বিক্রি তো দূরের কথা, আমার জানামতে ফারুক কখনোই মাদকসেবী ছিলেন না। যে ব্যক্তি কোনোদিন নেশাই করল না, তাকে পুলিশ মাদক বিক্রেতা বানিয়ে দিল!

ফারুকের বাসার গলিতে কয়েকজন তরুণের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ‘ফারুক ভাই একটা বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বডিগার্ড হিসেবে কাজ করতেন। আমরা এটাই জানি কিন্তু যেদিন শুনি তাকে পুলিশ ধরেছে অবাক হয়েছি। আরও অবাক হয়েছি তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে। এটা আসলে মৃত্যু না, মারধরেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে আমরা মনে করি। কারণ তিনি কখনো অসুস্থ ছিলেন না। আর পুলিশ বলছে, মাদক সেবনের কারণে তিনি মারা গেছেন। এটা সত্য নয়!

পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে বিপাকে পরিবার

পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস ছিলেন ফারুক। তার মৃত্যুতে হতাশার ছায়া নেমে এসেছে পরিবারটিতে। সামনে কীভাবে দিন কাটবে তা নিয়ে চিন্তিত ফারুকের পরিবার।

ফারুকের স্ত্রী হ্যাপী বলেন, ‘তাকে (ফারুক) ছাড়া আমরা এখন কী করে চলব? কী করব বুঝতে পারছি না। দুইটা ছেলের মাদরাসার বেতন, সংসারের খরচ কোথায় থেকে আসবে তাও জানি না।’

হ্যাপি বলেন, ‘আমার তিনটা বাচ্চা আজ সর্দি কাশিতে আক্রান্ত। ছোটটার জ্বর এসেছে। আমার তিন পোলা তার বাবারে না দেখতে পাইয়া অসুস্থ হইয়া গেছে। ওদের বাবা এতো পরিমাণ আদর করছে যে, তারা বাবার জন্য পাগল হইয়া গেছে। আমি এখনো তাদের বলতে পারি নাই তোমাদের বাবা দুনিয়াতে নাই। এখন আর তাদের কী জবাব দেব?

এমআইকে/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর