স্বদেশীয় বিদ্রোহীদের সঙ্গে তীব্র লড়াই চলছে মিয়ানমার জান্তা সরকারের। এতে বিভিন্ন প্রদেশের দখল হারাচ্ছে জান্তা সরকার। দেশটিতে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ এতটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে সীমান্তরক্ষী ও সরকারপন্থী বাহিনীর সদস্যরা। একের পর এক সীমান্তরক্ষী বা সেনা সদস্য অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে। সশস্ত্র এসব সদস্যের অনুপ্রবেশ উদ্বেগ বাড়িয়েছে সীমান্তবর্তী স্থানীয়দের মনে। ফলে প্রশ্ন উঠছে কী ঘটছে মিয়ানমার সীমান্তে, কেন পালাচ্ছে সীমান্তরক্ষীরা?
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, রোববার দুপুর থেকে তমব্রু ঘুমধুম সীমান্তে তিন জায়গা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্যরা। তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে ৬৮ জন সীমান্তরক্ষী।
বিজ্ঞাপন
এসব বিষয়ে কথা হয়েছে ঘুমধুম সীমান্তে বিজিবি ৩৪ ব্যাটেলিয়ানের অধিনায়ক আব্দুল্লাহ আল আশরোকির সঙ্গে। তিনি জানিয়েছেন, সীমান্তের তিনটি জায়গা দিয়ে মিয়ানমারের সিকিউরিটি ফোর্সের সদস্যরা বাংলাদেশে ঢুকছে। নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা তাদের প্রথমেই কর্ডন ও অস্ত্র আলাদা করেছি। আমরা তাদের নিরাপদ স্থানে রেখেছি।
রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাদের দ্রুতই বাংলাদেশ থেকে ফেরত পাঠাতে চেষ্টা চলছে।
কী ঘটছে মিয়ানমারে?
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলে সেনাবাহিনী। এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পথ বন্ধ হয় যায়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির জনগণ সেনাশাসন মেনে নেয়নি। তার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন গড়ে তোলে। কিন্তু জান্তা বাহিনী সেই আন্দোলনে নজিরবিহীন দমনপীড়ন শুরু করে। হাতে অস্ত্র তুলে নেয় জনতা। এরপর যতই সময় গড়িয়েছে, ততই বেড়েছে সশস্ত্র বিদ্রোহ।
অভ্যুত্থানের তিন বছর পরও সেই সশস্ত্র বিদ্রোহ ঠেকাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে জান্তা। শুধু তাই নয়, দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে। ফলে পতনের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে মিন অং হ্লাইংয়ের সরকার। আর তাই জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়েছে।
বিজ্ঞাপন
কেন পালাচ্ছে সীমান্তরক্ষীরা?
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে সে দেশের সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলছে কয়েক মাস থেকে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দখলে থাকা অনেক শহর ও এলাকা বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলেও খবর আসছে।
ইরাবতী। থাইল্যান্ডে নির্বাসিত মিয়ানমারের নাগরিকদের পরিচালিত একটি সংবাদমাধ্যম। রোববার তাদের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির আরেকটি ব্যাটেলিয়ন দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মির যোদ্ধারা।
আরাকান আর্মির বরাত দিয়ে ইরাবতী জানাচ্ছে, গত বুধবার রাখাইন রাজ্যের উপকূলীয় রামরি এলাকায় জান্তা বাহিনীর সঙ্গে তাদের লড়াই হয়। বঙ্গোপসাগরের ওই দ্বীপ শহরে আরাকান আর্মির যোদ্ধারা ঢোকার পর সেখানে জান্তা বাহিনীর অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সৈনিকদের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন তারা।
সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে, আরাকান আর্মি ১৩ নভেম্বর রাখাইনে ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরু করার পর সিতওয়ে-র নিকটবর্তী পাউকতাও শহর এবং চিন প্রদেশের পালেতাওয়া শহর-সহ ১৬০টি অবস্থান থেকে মিয়ানমার বাহিনীকে উৎখাত করেছে। এই ধারাবাহিকতায় গত জানুয়ারির শেষ দিকে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন ও আরাকান রাজ্যেও যুদ্ধ-পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। দু’পক্ষের সংঘাত এতটাই তীব্র আকার নেয় যে রোববার দুপুর থেকে মিয়ানমারের বিজিপি পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে।
ঘুমধুম সীমান্তে বিজিবি ৩৪ ব্যাটেলিয়ানেরর অধিনায়ক আব্দুল্লাহ আল আশরোকি বলেন, তিনটি স্থান থেকে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এবং সেটি এখনো অব্যাহত রয়েছে, ফলে এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
সীমান্ত পরিস্থিতি এখন কেমন?
রোববার মধ্য শেষ রাত থেকে গোলাগুলি শুরু হয় ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার অংশে। ভোররাত থেকে এই পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ওপারে গুলি ও মর্টারশেলের শব্দে কেঁপে ওঠে সীমান্তের বাংলাদেশ অংশও।
স্থানীয় সাংবাদিক আজিম নিহাই জানান, রোববার সকাল থেকে আমি তুমব্রুর পশ্চিমকূল মসজিদের পাশে অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে একজনকে অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশ অংশে ঢুকতে দেখলাম। তার হাতে অস্ত্র ছিল, তবে গায়ে সামরিক পোশাক ছিল না। কিন্তু দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য।
ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্ত থেকে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পাহারা দেখা যায় স্পষ্টভাবে। এই অংশে ছোট বড় তিনটি ক্যাম্প রয়েছে সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। গত শনিবার পর্যন্ত সেগুলো জান্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণেই ছিল।
গণমাধ্যমকর্মী আজিম নিহাই জানান, রোববার সকাল থেকে দেখা যায় ৩৪ পিলার রাইট ক্যাম্পটি দখলে নিয়ে নিয়েছে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। এটি দখলের পর আরাকান আর্মি ঢেকিবুনিয়া ক্যাম্পের দিকে রওনা দিয়েছে তা এপার থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গোলাগুলির সময় কিছুক্ষণ পরপর মিয়ানমার সীমান্তে হেলিকপ্টারের মহড়া দেখা যাচ্ছে। যেগুলো ব্যবহার করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এই গোলাগুলির মধ্যেই কিছুক্ষণ পরপর দু-একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে যেতেও দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার পালিয়ে আসছে বাংলাদেশ অংশে।
ঘুমধুম সীমান্তে বিজিবি ৩৪ ব্যাটেলিয়ানেরর অধিনায়ক আব্দুল্লাহ আল আশরোকি বলেন, আমাদের স্থানীয় বাসিন্দাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার জন্য স্থান ত্যাগের কথা আগে থেকেই বলা হয়েছে। অন্যান্য প্রয়োজনীয় যে সকল ব্যবস্থা রয়েছে, সীমান্ত রক্ষার জন্য তা জোরদার করেছি।
সীমান্তে স্কুল বন্ধ, আতঙ্কিত লোকজন
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি চললেও তা এপাড়ে এসেও পড়ছে। এ ঘটনায় রোববার সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে একজন গুলিবিদ্ধ ও আরেকজন আহত হয়েছে। এমন অবস্থায় পুরো সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন অনেকে।
শনিবার রাতে মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া একটি মর্টারশেল এসে পড়ে তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ার ইউনুছ ওরফে ভুলুর বাড়িতে। বাড়ির টিন ছিদ্র হয়ে মর্টারশেলটি ঘরের ভেতরে এসে পড়ে। তবে সে সময়ে পরিবারের সদস্যরা কেউ বাড়ি না থাকায় হতাহত হননি কেউই। এই অবস্থায় ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তের কাছে পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এক দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
বন্ধ হওয়া স্কুলগুলো হলো বাইশপারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু পশ্চিমকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রেজু গর্জন বুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এগুলো সোমবারও বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছেন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া।
মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, আরও তিনটা স্কুল স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে। অবস্থা খারাপ হলে সেগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষার একটি কেন্দ্র সরানোর জন্য কাজ চলছে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে কেন্দ্রও সরানো হবে।
বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সতর্ক করা হচ্ছে। কক্সবাজারের জেলা পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, এখানকার পরিস্থিতি উদ্বেগজক। বিজিবি তার শক্তি জোরদার করেছে। সীমান্ত বরাবর তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে যেন কেউ প্রবেশ করতে না পারে।
চীনের হস্তক্ষেপ চায় বাংলাদেশ
মিয়ানমারের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীনের কাছে সহযোগিতা চাওয়ার কথা বলছে বাংলাদেশ। রোববার সচিবালয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকে বলেন, মিয়ানমারে যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার আঁচ বাংলাদেশের সীমান্তে এসে পড়ছে। ফলে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে চীনের সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে সহযোগিতার জন্য ইতিবাচক সাড়াও দিয়েছে চীন।
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, যুদ্ধটা তাদের অভ্যন্তরীণ। কিন্তু সীমান্তে গোলাগুলির আওয়াজ আমাদের এখানে যখন চলে আসে, স্বাভাবিক কারণে ভয়ভীতিও আসতে পারে। এজন্য চীনের হস্তক্ষেপ চেয়েছি। সূত্র: বিবিসি
এইউ