আগামীকাল ১৪ জানুয়ারি পুরান ঢাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎসব সাকরাইন পালিত হবে। ছয় ঋতুর দেশে এখন চলছে শীতকাল, যা বাংলা মাসের হিসেবে পৌষের বিদায়ক্ষণ। বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে এই পৌষ মাসের শেষ দিনটিকে ঘিরে রয়েছে একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের কাছে যা সাকরাইন উৎসব হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ এটিকে পৌষসংক্রান্তিও বলে থাকে।
পুরান ঢাকায় ১৪ জানুয়ারি পালিত হয় সাকরাইন উৎসব। তবে শাঁখারিবাজারের আদি হিন্দু পরিবারগুলো একদিন পর অর্থাৎ ১৫ জানুয়ারি এই উৎসব পালন করে। বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে ছোটবড় সবাই মেতে উঠে এই উৎসবে। দিনের শুরু থেকেই পুরান ঢাকার বাড়িতে বাড়িতে চলে পিঠা বানানোর ধুম। সারাদিন এসব এলাকায় আকাশে রঙ-বেরঙের ঘুড়ি ওড়ে। ছাদে কিংবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। বেশির ভাগ সময় ঘুড়ি কাটাকাটি প্রতিযোগিতা চলে। একজন অপরজনের ঘুড়ির সুতা কাটার প্রতিযোগিতা করে।
বিজ্ঞাপন
শনিবার (১৩ জানুয়ারি) সরেজমিনে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, সাকরাইনকে সামনে রেখে পুরান ঢাকায় উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া, লালবাগ ও এর আশেপাশের এলাকাগুলোর মানুষেরা সাকরাইন উৎসব পালন করতে প্রস্তুত হচ্ছেন। বেশিরভাগ বাসার ছাদে সাউন্ড-সিস্টেম, আলোকসজ্জা ও লাইটিং করে সাজানো হচ্ছে।

শাঁখারীবাজারের ঘুড়ি ও আতশবাজির দোকানগুলোতে বেড়েছে ক্রেতাদের ভিড়। শাঁখারীবাজারের কয়েকজন দোকানির সাথে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি এখানে তৈরি হয়। এসবের নামও বেশ চমৎকার। যেমন চোখদার, পানদার, বলদার, দাবাদার, লেজওয়ালা, পতঙ্গ ইত্যাদি নামের ঘুড়ি। তারা আরও জানান, সাধারণ ঘুড়িগুলোর দাম পাঁচ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে, হরেক রকমের ডিজাইন করা ঘুড়িগুলোর দাম ১৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকার বেশি। এছাড়াও দোকানগুলোতে ভারত ও চীনের ঘুড়িও পাওয়া যায়। তারা এই সাকরাইন উৎসব চলাকালে ঘুড়িগুলো নিজেরাই প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে তৈরি ও আমদানি করে থাকে।
বিজ্ঞাপন
তবে এবারের ইংরেজি নববর্ষের অনুষ্ঠানে ফানুস ও আতশবাজিতে বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনা ঘটায় সরাসরি এসব বিক্রি হচ্ছে না শাঁখারীবাজারে। তবে গোপনে চলছে বিকিকিনি। কয়েকটি গলির মাথায় ও দোকানের কোণে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে বেশ কয়েকজন তরুণ ও কিশোরকে। যাদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৫ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। কেউ কিনতে এসে খোঁজাখুঁজি করলে কোনো না কোনোভাবে টের পেয়ে যায় গলি ও দোকানের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলো। তখনই চার-পাঁচজন এসে হাজির। গলির ভেতর ডেকে নিয়ে চলে দরদাম। এভাবেই প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলছে আতশবাজির বিকিকিনি।
শাঁখারীবাজারের ঘুড়ির দোকানি জনি সেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বছরের শুরু থেকেই দোকানে সাকরাইনের জন্য সবধরনের মালামাল উঠাইছি, বেশি কইরা উঠাইছি ঘুড়ি, আবির, সুতা, লাটাই। অহন বিক্রি একটু কম হইতাছে তই বৃহস্পতিবার অনেক বিক্রি হইবো। আর এবছর লাভের হার একটু কমই হইতাছে। আবার ত শুরু হইছে সরকারের নিষেধ জারি, তাই বেচাকেনা যা ছিল তাও কম হচ্ছে।’

ঘুড়ি কিনতে আসা সাখাওয়াত হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি তিন ধরনের ঘুড়ি কিনেছি, সুতা-লাটাই আগে থেকেই আছে। বাসায় গিয়ে ঘুড়ির জন্য কিছুটা কাজ করব, তারপর সাকরাইনের দুই দিন দুপুরের পর থেকে আমরা বাড়ির সবাই মিলে ছাদে ঘুড়ি উড়াব, গানবাজনা করব। তবে করোনা আবার বাড়ার কারণে হয়তো আমার বন্ধুদের সাথে সাকরাইন পালনে সীমাবদ্ধতা থাকবে।’
সাকরাইন নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সোহেল ইমাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এটা পুরান ঢাকার আদি ঐতিহ্য। সারাদিন ঘুড়ি উঠানো শেষে রাতেরবেলা আতশবাজি ফুটানো হয়। দিনভর উৎসবমুখর পরিবেশ থাকে। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ একসাথে হয় সাকরাইনে। পুরান ঢাকার বাইরে থেকেও লোকজন আসে সাকরাইন উৎসবে যোগ দিতে। কর্মব্যস্ত থাকার পরেও সাকরাইনে উৎসবে সবাই মেতে ওঠে।’
এবারের সাকরাইনে ফানুস উড়ানো ও আতশবাজি ফুটানোর কোনো বিধি-নিষেধ আছে কি না জানতে চাইলে সুত্রাপুর থানার ওসি মাসুদ আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এটা মূলত পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে ডিএমপি কমিশনার স্যার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। প্রতিবারের মতো ফানুস উড়ানো এবারও নিষিদ্ধ। তবু বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জায়গায় উড়ানো হয়, আমরা এটা প্রতিরোধের চেষ্টা করব। সাকরাইনে যাতে কোনো ধরনের জনসমাগম না ঘটে সে দিকে আমরা লক্ষ্য রাখব।’
প্রতিনিধি/জেবি

