প্রকৃতিতে বইছে হিমেল হাওয়া, শিরশিরি এ হাওয়ায় দিনে সূর্যি মামার মিষ্টি রোদ এমনিতেই মন কাড়ে। কুয়াশায় বিকেলেই যেন সন্ধ্যা নামে। এমন বৈরি দিনেও শেরপুরের দুইশো বছরের পুরোনো পৌষ মেলায় উষ্ণতায় মজেছেন দর্শনার্থীরা। এ মেলার প্রধান আকর্ষণ ঘোড়দৌড়, সাইকেল রেস ও গাঙ্গী বা কুস্তি খেলা।
পৌর শহরের নবীনগর ছাওয়াল পীরের দরগা সংলগ্ন খোলা মাঠে আয়োজিত এই মেলা শুক্রবার (২৯ ডিসেম্বর) দুপুর থেকে শুরু হয়ে চলে রাত পর্যন্ত। শীত উপেক্ষা করে মেলায় প্রতি বছরের মতো শিশু, নারী ও পুরুষসহ সব বয়সী মানুষের উপচে পড়া ভিড়। ছিল বিভিন্ন খেলাধুলার প্রতিযোগিতা আর পিঠা-পুলি, মুড়ি-মুড়কি, খেজুরের রস, নলের গুড়, শিরনি-পায়েস, মধুসহ বাহারীসব খাবারের দোকান।
বিজ্ঞাপন
এদিকে, মেলাকে ঘিরে শেরপুর শহরের নবীনগরসহ আশেপাশের এলাকায় উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। নবীনগরবাসীর দাবি, ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদের বাপ-দাদাদের আমল থেকে চলে আসছে এই পৌষ মেলা। পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য এই মেলা ধরে রাখার প্রত্যয় জানিয়েছেন আয়োজকরা। তারা আরও জানান, এক সময় বাঙালির ঐতিহ্য ধরে রাখতে মেলা উপলক্ষে আশপাশের গ্রামের মানুষ ভোরে উঠে হলুদ ও সর্ষেবাটা দিয়ে গোসল করতেন। তবে সময়ের পরিক্রমায় এই প্রথা হারিয়ে গেছে।
মেলার আয়োজক কমিটি জানায়, প্রতিবছর এই মেলাটি মূলত ৩০শে পৌষ অনুষ্ঠিত হলেও কয়েক বছর ধরে বোরো আবাদের জন্য সংক্রান্তির আগেই আয়োজন করা হচ্ছে। পৌষ মেলায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবার মুড়ি-মুড়কি, মোয়া, নিমকি, গজা, খোরমা, কলাই, চানাচুর, বাদাম কটকটি, তিলের খাজা, মুড়ি-মুড়কি, খেজুরের রস, নলের গুড়, শিরনি-পায়েস, মধু এবং প্লাস্টিক ও মাটির তৈরি শিশুদের বিভিন্ন খেলনা ও নারীদের বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রীর পাশাপাশি গৃহস্থালির বিভিন্ন পণ্যের পসরা বসে।
![]()
পৌষ মেলার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে— ঘোড়দৌড়, সাইকেল রেস ও গাঙ্গী বা কুস্তি খেলা। যা এখন প্রায় হারিয়েই গেছে। বড়-মাঝারি-ছোট এ তিনটি গ্রুপে অনুষ্ঠিত হয় গাঙ্গী খেলা। আর আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আসেন ২০ ঘোড়সওয়ার। এখন এসব খেলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারীদের মিউজিক্যাল চেয়ার, বালিশ খেলাসহ নানা গ্রামীণ বিভিন্ন খেলা ও প্রতিযোগিতা। মেলায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় আকর্ষণীয় পুরস্কার।
বিজ্ঞাপন
মেলাকে কেন্দ্র করে নবীনগর ও আশেপাশের এলাকার মেয়েরা স্বামী-সন্তানসহ বাপের বাড়ি বেড়াতে আসেন। এসব এলাকায় নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সের হাজারো মানুষের ঢল নামে। স্থানীয়দের ঘরে ঘরে চলে পিঠা-পায়েস, শিন্নী, নাশতা খাওয়ার উৎসব। এ উৎসবকে ঘিরে প্রায় প্রতি বাড়িতেই দূর-দূরান্তের আত্মীয়রা ছুটে আসে পিঠা খেতে এবং মেলা দেখতে। এ যেন ঈদের আমেজ। ঐতিহ্যবাহী এ মেলাটি আরও বড় পরিসরে অনুষ্ঠানের দাবি জানান মেলায় আসা দর্শনার্থীরা।
শেরপুর পৌর শহরের মোবারকপুর মহল্লার বাসিন্দা কলেজ শিক্ষার্থী সুমাইয়া শিমু জানান, শহর ঘেঁষে এত সুন্দর এই মেলার আয়োজন সত্যিই মনোমুগ্ধকর। এটা আমাদের জেলার ট্রেডিশন ক্যারি করে। তাই আমরা চাই মেলার পরিসর ও সময় আরও বাড়ানো হোক। তাতে শহরের ছেলেমেয়েরা মন খুলে আনন্দ, মজা, মাস্তি করতে পারবে।
নকলার কায়দা ইউনিয়নের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, প্রতিবছর মেলাতেই আমি আসি। যদিও আজ বাড়িতে প্রচুর কাজ ছিল। তবুও কাজ ফেলে এসেছি। এখানকার মুখরোচক গ্রামীণ খাবার কিনে নিয়ে যাই বাচ্চাদের জন্য। এছাড়া খেলাধুলা উপভোগ করি, বিশেষ করে কুস্তি খেলাটা মন কেড়েছে।
মেলায় প্রথমবারের মতো স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে এসেছেন শহরের সজবরখিলা মহল্লার বাসিন্দা স্কুল শিক্ষিকা নুসরাত ইমরোজ দিয়া। তিনি জানান, আমার মূলত বাড়ি জামালপুরের বকশিগঞ্জ। চাকুরির সুবাধে দুবছর ধরে শেরপুরে আছি। গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেলার তথ্য পেয়েছি। শহরের পাশেই এত সুন্দর এই মেলায় এর আগে কখনও আসা হয়নি। প্রথমবারের মতো আজকে এসে মেলায় ঘুরে বেশ আনন্দ লাগছে। বিশেষ করে নারীদের জন্যও খেলার আয়োজনও আছে, আছে গ্রামীণ বিভিন্ন খাবারের পসরা।
চেয়ার খেলায় অংশ নেওয়া কিশোরী ঈতি পারভীন বলেন, পরিবারের সঙ্গে প্রতি বছরই তিনি মেলায় এসে খেলায় অংশ নেন। গতবছর পুরস্কার জয়ী হলেও এবার আর হয়ে ওঠেনি।
![]()
মায়ের সঙ্গে ঘুরতে এসেছেন ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাফিস আল রাফি। সে জানায়, এ নিয়ে দুইবার এসেছে মেলায়। বিভিন্ন খাবার যেগুলো বইয়ে পড়েছে, সেগুলো এখানে এসে খেতে পেরেছে। তাছাড়া ঘোড় দৌড় তার কাছে চমৎকার লেগেছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সোহেল রানা বলেন, আমাদের মুরুব্বিদের কাছ থেকে ছোট হতেই জানতে পেরেছি এ মেলার বয়স প্রায় দুইশো বছরের পুরোনো। আমাদের নবীনগরবাসীর একটি ঐতিহ্য এটি। এ ঐতিহ্য কেবল আমাদেরই নয়; সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই সকলের আন্তরিক ভালোবাসা।
নবীনগর পৌষ মেলা আয়োজক কমিটির অন্যতম সমন্বয়কারী ও শেরপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র মো. নজরুল ইসলাম জানান, আগে প্রতিবছর বাংলা পৌষ মাসের শেষদিন (পঞ্জিকা মতে) ছাওয়াল পীরের দরগাহ সংলগ্ন মাঠে এ পৌষমেলা অনুষ্ঠিত হতো। এ মেলা আমাদের বাপ দাদার আমল থেকেই চলে আসছে। তবে এখন সময় একটু এগিয়ে আনা হয়েছে। আমরা ছোট থেকেই শুনে আসছি কয়েকশ বছর ধরে এ মেলা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এটি আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। আমাদের পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য বজায় রাখতে শেখ মমতাজ আলীর নেতৃত্বে মেলা উদযাপন কমিটি প্রতিবছরই এ পৌষমেলার আয়োজন করবে। এতে সবার সহযোগিতাও চান এ জনপ্রতিনিধি।
টিবি

