ঘর থেকে দু পা ফেলে বাইরে বের হতেই গায়ে লাগছে বাতাসের দোলা। এই বাতাস কিছুটা অন্যরকম। কিছুটা হিমেল তার স্পর্শ। দূরে কোথাও ঝরে পড়ছে কিছু শুকনো পাতা। নাকে ভেসে আসছে মাতাল করা কোনো সফেদ ফুলের ঘ্রাণ। পায়ের নিচে থাকা ঘাসের নাকের ডগায় আসন গেড়েছে শিশিরকন্যা।
প্রকৃতির এমন আয়োজনই বলে দেয়, কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। শুভ্র শরতকে বিদায় জানিয়ে এসেছে হেমন্ত। আজ ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু হেমন্তের প্রথম সকাল। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ এই দুই মাস নিয়ে হেমন্তকাল। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কাশফুলে হালকা শিশির পরশ বুলিয়ে জানান দেয়, সামনেই আসছে শীত। কৃষকের মুখে এক চিলতে প্রাপ্তি আর প্রশান্তির হাসি এঁকে দেয় হেমন্ত।
বিজ্ঞাপন

‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;’- কবি জীবনানন্দ দাশ কার্তিক নবান্নের দেশে ফিরে আসতে চেয়েছেন ভোরের কাক হয়ে। এই ঋতুর রূপ অন্তর থেকে অনুভব করেছিলেন তিনি।
হেমন্তকে বলা হয় প্রকৃতির স্বর্ণঋতু। তার কারণও আছে বটে। কৃষকের সবুজ ধানের ক্ষেত হয়ে ওঠে সোনালি। হেমন্ত এসে জানান দেয়, ফসল ঘরে তোলার সময় হলো। মাঠজুড়ে সোনালি ধানের দোলা সবার মন করে শিহরিত। সকালের সোনা রোদ, সোনালি ধান আর সবুজ মাঠ জুড়ে সৃষ্টি করে অপরূপ এক সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্যের অলঙ্কার হয়ে কার্তিকের ভোরে ধানের ডগায় মুক্তার মতো শিশিরকণা সজ্জিত হয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপন
একসময় কিন্তু বাংলায় বছর শুরু হতো এই হেমন্ত দিয়েই। কারণ, এই ঋতু ধান উৎপাদনের। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আউশ-আমন বেড়ে ওঠে শরতে। কার্তিকে এসে তা পায় পরিপক্বতা। মন মাতানো ঘ্রাণের নানা ফুল ফোটে এই ঋতুতে। হেমন্তের ফুলের তালিকায় রয়েছে গাঁদা, গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, কামিনী, হিমঝুরি, দেব কাঞ্চন, রাজ অশোক, ছাতিম, বকফুল ইত্যাদি।
আরও পড়ুন: রৌদ্র-মেঘের শামিয়ানায় প্রকৃতিতে ‘শরৎ’ রাজত্ব
নাগরিক কোলাহলে হেমন্তকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দালানকোঠা আর জ্যামের শহরে তার দেখা মেলে না। মিললেও যান্ত্রিক জীবনের ফাঁকে হেমন্তকে বরণ করার অবসর পাওয়া যায় না। তবে পল্লীগ্রামে হেমন্তকে ঘিরে চলতে থাকে নানা আয়োজন। গ্রামীণ বাংলার সংস্কৃতিতে হেমন্তকে ঘিরে উৎসবের আমেজ যেন চিরকালীন শাশ্বত রূপ। কৃষকরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন সোনার ফসল ঘরে তুলতে। কৃষাণীর ব্যস্ত সময় কাটে ধান নিয়ে। সকাল-সন্ধ্যা চলতে থাকে ধান মাড়াই, রোদে শুকানোর কাজ।

অগ্রহায়ণে ঘরে ঘরে শুরু হয় বাংলার ঐতিহ্য ‘নবান্ন উৎসব’। নবান্ন শব্দের অর্থ নতুন অন্ন। হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই এই উৎসবের সূচনা। ধান কাটার পর সেই ধান থেকে চাল বের করা হয়। এই চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজন করা হয় উৎসবের।
নতুন ধানের চাল দিয়ে রান্না করা হয় ফিরনি-পায়েস। সেটি বিলানো হয় পাড়া প্রতিবেশীদের ঘরে। বিভিন্ন অঞ্চলে বানানো হয় বাহারি পিঠা। মুখরোচক এসব পিঠা খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন সবাই।

কেবল উৎসব নয়, এই নবান্নকে ঘিরে বসে গ্রাম্য মেলা। লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়া, পুতুল নাচ, বায়স্কোপ সব মেলে এখানে। সঙ্গে থাকে দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কালের স্রোতে সেই নবান্নর আমেজও এখন কিছুটা পানসে হয়ে যাচ্ছে।
নবান্ন উৎসবে নতুন জামাইকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। মেয়েকে বাপের বাড়িতে আনা হয় ‘নাইওর’। সবকিছু মিলিয়ে চারপাশে যেন উৎসবের মেলা বসে। এর কিছু পরই আশেপাশে আনাগোনা ঘটায় অতিথি পাখিরা। হেমন্তের শেষের দিকের প্রকৃতিকে ভালোবেসে এ দেশে আসে তারা। প্রকৃতিও তখন মুখর হয়ে পড়ে অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে।

হেমন্তে নানা ফলো পাওয়া যায়। কামরাঙ্গা আর চালতা এ ঋতুর বিশেষ ফল। হেমন্তের প্রধান ফল নারিকেল। আর তাইতো নতুন চালের গুঁড়ার সঙ্গে নারিকেল মিশিয়ে নানারকম পিঠা তৈরির ধুম চলে ঘরে ঘরে। সারা রাত জেগে পিঠা তৈরি করেন গৃহিণীরা। কষ্ট সার্থক করে পিঠা বানানো শেষে তা বিতরণ করেন পাড়া-পড়শিদের মাঝে। মজবুত হয় বন্ধন, বৃদ্ধি পায় পারস্পরিক ভালোবাসা।
আরও পড়ুন: প্রকৃতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চারে এলো বর্ষা
শরৎ আর শীতকে এক বন্ধনে মেলানোর ঋতু হেমন্ত। শরতের তুলোর মতো সাদা মেঘকে পাশ কাটিয়ে, কাশফুলকে বাতাসে উড়িয়ে নিজের জায়গা দখল করে সে। অন্যদিকে নরম কুয়াশার চাদর বিছিয়ে, সোনা রোদের উষ্ণতা দিয়ে, রঙ বেরঙের আনন্দ উৎসব দিয়ে জানান দেয় শীত আসি আসি করছে। সবাই এক সুতোয় বাঁধাই যেন হেমন্তের কাজ, হোক তা মানুষ কিংবা প্রকৃতি। আর তাইতো হেমন্তকে বলা হয় ‘ঋতুকন্যা’।

প্রকৃতিতে আগামী দুই মাস বিরাজ করবে হেমন্ত। পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ, দূরের বনে পাখির খুনসুটি, দু’একটা ফুলের ঝরে পড়া আর ভোরের ঘাসে ভেজা শিশির আমাদের উপলব্ধি করাবে তার আগমন। আর কিষাণপাড়ায় শুরু হবে শত কষ্টের পর খানিকটা প্রশান্তি উদযাপন।
এনএম

