বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

‘কার্টুন ছাড়া খাবই না’

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ১০ আগস্ট ২০২২, ০৯:১৮ এএম

শেয়ার করুন:

‘কার্টুন ছাড়া খাবই না’

প্রথম শ্রেণির ছাত্র পুলক। বাংলা এখনও পুরোপুরি স্পষ্টভাবে বলতে শেখেনি। যুক্তাক্ষর রয়েছে এমন শব্দ উচ্চারণে খানিকটা আটকে যায়। তবে হিন্দি ভাষায় কোনো জড়তা নেই পুলকের। নিজের যেকোনো অনুভূতি হিন্দিতে চটজলদি প্রকাশ করতে পারে সে। নাহ, কোনো ভিনদেশি ভাষা শেখার কোর্স নয়, মোবাইল আর টেলিভিশনের পর্দায় রোজ কার্টুন দেখেই শিখেছে এই ভাষা। 

সদ্য স্কুলে পাড়ি জমানো রুবিরও একই হাল। নাকিনাকি কণ্ঠ ছাড়া কথাই বলতে পারে না সে। নাক বা কণ্ঠনালীর কোনো সমস্যা নয়, প্রিয় কার্টুন চরিত্র শিনচ্যানকে অনুকরণ করতে গিয়েই তার এই হাল। শিনচ্যানের মন খারাপ থাকলে রুবি কাঁদে, সে হাসলে হাসে। সম্প্রতি মায়ের কাছে বায়না ধরেছে হলুদ রঙা প্যান্ট আর লাল গেঞ্জি কিনে দেওয়ার জন্য। শিনচ্যান এমন পোশাক পরে কিনা! 


বিজ্ঞাপন


শিশুদের কার্টুনপ্রীতি বাঁ কার্টুনকে অনুকরণ করার প্রবণতা বেশ পুরনো ও স্বাভাবিক। তবে এখন যেন তা বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশুরা কার্টুন দেখতে না দিলে খাবে না বলে জেদ করছে। ঘুমানোর আগে কার্টুন না দেখলে তাদের চোখে ঘুম আসে না। ঘুমপাড়ানি মাসি পিসির গল্পে এখন আর তাদের মন ভরে না। 

kidমা-বাবাও সেই সুযোগ নিচ্ছেন। নিজের কর্মব্যস্ত জীবনে সন্তানকে সঙ্গী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন কার্টুনের সঙ্গে। কার্টুন দেখানোর শর্তে তাদের দিয়ে করাচ্ছেন না কাজ। এই যেমন রোজ স্কুলে গেলে কার্টুন দেখতে দিব, হোমওয়ার্ক শেষ করলে কার্টুন দেখতে পারবে, সময়মতো খেলে কার্টুন দেখতে পারবে আরও বেশি সময়— এমন আরও কত লোভনীয় অফার। 

শিশুরাও মা-বাবার সঙ্গে টেক্কা দিচ্ছে নিজের গতিতে। কার্টুনের দেখার সুযোগ লুফে নিচ্ছে নানাভাবে। কার্টুন ছাড়া খাবই না, কার্টুন দেখতে দিলে তবেই হোম ওয়ার্ক করতে বসা, আগে কার্টুন তারপর ঘুম... সবকিছু মিলিয়ে মা-বাবা জিম্মি শিশুর কাছে আর শিশুর মস্তিষ্ক জিম্মি ভিনদেশি কার্টুনে।

শিশুরা স্বভাবতই অনুকরণ প্রিয়। বিভিন্ন কার্টুন দেখে প্রিয় কার্টুন চরিত্রের ভাষা থেকে শুরু করে পোশাক, আচরণ, হাটা-চলার ধরন সবকিছুই তারা অনুকরণ করতে চায়। ফলে হারাচ্ছে নিজস্বতা, নিজের সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ আর নিজের মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশ করার ক্ষমতা।


বিজ্ঞাপন


kidশিশুদের কার্টুন দেখার বিষয়টি নিয়ে মনোবিদ কায়লা বইস আর ব্র্যাড বুশম্যান মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে একটি সমীক্ষা করেন। এতে দেখা যায়, দুই থেকে পাঁচ বছরের শিশুরা সপ্তাহে গড়ে ৩২ ঘণ্টা কার্টুন দেখে। ছয় থেকে এগারো বছরে তা নেমে আসে ২৮ ঘণ্টায়। শতকরা ৫৩ শতাংশ ক্ষেত্রে কার্টুন দেখার সময় শিশুরা অভিভাবকের তত্ত্বাবধান থেকে দূরে থাকে। এভাবে নিয়মিত কার্টুন দেখার ফলে বদলে যায় শিশুর আচার-আচরণ। যার ফলে নিরীহ বাধ্য শিশু হয়ে উঠতে পারে হিংস্র। 

যেই বয়সে শিশুর মানসিক বিকাশ নিয়ে ভাবার কথা, সেই বয়সে মা-বাবা তাদের ঠেলে দিচ্ছেন কার্টুনের রঙিন জগতে। কর্মজীবনে ব্যস্ততা শেষে সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতেও আশ্রয় নিচ্ছে কার্টুনের। শিশুকে দিচ্ছেন প্রিয় কার্টুন চরিত্রের ছবি সম্বলিত ব্যাগ, ফ্ল্যাক্স কিংবা টিফিন বক্স। 

সবমিলিয়ে অভিভাবকের হেঁয়ালিতে শিশু রপ্ত করছে ভিন দেশের ভাষা আর সংস্কৃতি। হয়তো একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবেন আপনার আদরের সন্তান অঙ্ক ভুল করে চিৎকার করা কাঁদছে আর বলছে, ‘ডরিমন, মুজেহ মাদাত কারো’। আপনার সাহায্য না চেয়ে ডরিমনের সাহায্য চাওয়াতে অবাক হবেন না যেন। কেননা আপনিই তাকে সে সুযোগ করে দিয়েছেন।

kidতাহলে উপায় কী? 

শিশুকে কার্টুনের এই বিপদগামী পথ থেকে ফেরানোর দায়িত্ব আপনারই। কথা হচ্ছে কীভাবে? হুট করে কার্টুন দেখা বন্ধ করে দিলে শিশু তা মানবে না। এটি তার মনেও খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। শুরুতে কার্টুন দেখার সময় বরাদ্ধ করে দিন। রোজ সর্বোচ্চ দেড় ঘণ্টার বেশি সময় যেন কিছুতেই কার্টুন না দেখে।

বাংলা ভাষায় কিছু শিক্ষামূলক কার্টুন রয়েছে। বিভিন্ন ছড়া বা পড়া শেখার মজার কৌশলের কার্টুনগুলো নির্বাচিত করতে পারেন তার জন্য। যদি এমন কার্টুন সিরিজ খুঁজে পান যাতে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি ফুটে ওঠে তবে তাই নির্ধারিত করুন শিশুর জন্য।

শিশুর মানসিক বিকাশ হবে এমন খেলনার সঙ্গে পরিচয় করান। বিভিন্ন রঙ খুঁজে বের করা, পাজল মেলানো, রুবিক্স কিউব ইত্যাদি তার জন্য উপযুক্ত। তাকে পরিচয় করান রঙিন বইয়ের সঙ্গে। নিজে বই থেকে গল্প পড়ে শোনান। শিশু একটু বড় হলে তাকেও পড়তে বলুন। 

kidব্যস্ততা সবারই থাকে। তবুও শিশুর জন্য একটু সময় বের করুন। ছুটির দিন তাকে নিয়ে ঘরের বাইরে বের হোন। পার্ক কিংবা ছোটদের খেলার জায়গায় ঘুরিয়ে আনুন। মা-বাবার সান্নিধ্যে থাকলে শিশুর মন ভালো থাকে। 

গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর পুরনো অভ্যাস আবার ফিরিয়ে আনুন। রূপকথার গল্পের জগতে ডুব দিন। ধীরে ধীরে সন্তানকে বের করে আনুন কার্টুনের বিষাক্ত ছোবল থেকে। 

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর