শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

এগিয়ে আসছে পিরিয়ড শুরুর সময়, উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ১১ আগস্ট ২০২৫, ০৪:১১ পিএম

শেয়ার করুন:

এগিয়ে আসছে পিরিয়ড শুরুর সময়, উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা

তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী আনিশা। বয়স সবে ৮। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর মা আতিয়া খান (ছদ্মনাম) খেয়াল করলেন পোশাকে রক্ত। অজানা আশঙ্কায় ভরে উঠল মন। কীসের ইঙ্গিত এটি? মেয়ের সঙ্গে খারাপ কিছু হয়নি তো? নাকি পিরিয়ড হয়েছে? কিন্তু এত কম বয়সে তো পিরিয়ড হওয়ার কথা নয়। তবে কি এটি বড় কোনো স্বাস্থ্য সমস্যার ইঙ্গিত? 

জানলে অবাক হবেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ অভিভাবকই জানেন না মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হওয়া বা বয়ঃসন্ধিকালের সময় এগিয়ে এসেছে। একটা সময় ১০-১২ বছর বয়সে মেয়েরা প্রথমবার ঋতুমতী হতো। সময়ের সঙ্গে সেটি এসে ঠেকেছে ৮ এ। বর্তমানে অসংখ্য মেয়ের পিরিয়ড শুরু হচ্ছে ৮-৯ বছর বয়সে। 


বিজ্ঞাপন


কেন এগিয়ে এসেছে পিরিয়ড শুরুর সময়? এর পেছনে দায়ী কী কারণ? ভবিষ্যতে এটি কি অন্য কোনো সমস্যার কারণ হতে পারে? অভিভাবক হিসেবে আপনার করণীয় কী?— সব প্রশ্নের উত্তর জানুন এই প্রতিবেদনে। 

period1

করোনা পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে এসেছে অনেক পরিবর্তন। নানা স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা হচ্ছে মানুষের সঙ্গী। করোনা, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো পিরিয়ডের বয়স এগিয়ে আসার পেছনে কিছুটা দায়ী বলা যায়। 

মুম্বাইয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ ইন রিপ্রোডাকটিভ অ্যান্ড চাইল্ড হেলথের মতে, বর্তমানে ৮ বছরের আগেই মেয়েদের মধ্যে বয়ঃসন্ধির লক্ষণ বা পিরিয়ড দেখা যাচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘আর্লি পিউবার্টি’ বলে।


বিজ্ঞাপন


আর্লি পিউবার্টি কী?

অ্যাডভান্সড ল্যাপরোস্কোপিক সার্জন অ্যান্ড ইনফার্টিলিটি স্পেশালিস্ট ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘মেয়েদের আট বছর বয়সের আগে যদি ব্রেস্ট ডেভেলপমেন্ট হয় বা পিউবিক হেয়ার জন্মায় এবং ছেলেদের ন’বছরের আগে যদি টেস্টিকুলার এনলার্জমেন্ট, পেনাইল এনলার্জমেন্ট বা পিউবিক হেয়ার জন্মায়, তাকে চিকিৎসার পরিভাষায় আর্লি পিউবার্টি বা প্রিকশাস পিউবার্টি বলা হয়’। 

period2

বয়ঃসন্ধির লক্ষণ কী? 

পিউবার্টির পদচারণার লক্ষণ অনুভূত হয় সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল ক্যারেক্টারিস্টিকসের উপস্থিতির মাধ্যমে। মেয়েদের প্রথমে ব্রেস্ট বাড দেখা দেবে এবং ধীরে ধীরে ব্রেস্ট ডেভেলপমেন্ট হবে। এরপর পিউবিক হেয়ার ও আর্মপিট হেয়ার (গোপনাঙ্গ ও বগলের লোম) জন্মাবে। সাধারণত এসব লক্ষণ দেখা দেওয়ার বছর দুয়েকের মধ্যে মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়।

আর্লি পিউবার্টির কারণ কী?

আর্লি পিউবার্টির হার এখনও অব্দি কম। পিটুইটারি গ্ল্যান্ডে বা ব্রেনের কিছুটা অংশ যা পিটুইটারিকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে কোনো অস্বাভাবিকত্ব থাকলে কিছুক্ষেত্রে এমনটা হতে পারে। এর কারণে প্রিকশাস পিউবার্টি হলে তাকে বলা হয় সেন্ট্রাল প্রিকশাস পিউবার্টি। 

এছাড়া পেরিফেরাল কারণেও আর্লি পিউবার্টি হতে পারে। যেমন, ওভারিতে কোনো টিউমার বা সিস্ট থাকলে (যা থেকে ইস্ট্রোজেন নিঃসৃত হচ্ছে)। 

period3

বর্তমানে অধিকাংশ বাচ্চা মেয়েরই বয়ঃসন্ধি শুরু হয়ে যায় নয় বা দশ বছরের মধ্যে এবং কিছুক্ষেত্রে ৮ বছরে। পিউবার্টির বয়স যে আগের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে এসেছে, তা অস্বীকার করা যায় না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, ‘এখনকার অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারে একটি বা দুটি সন্তান এবং বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়ের পুষ্টির দিকটা খেয়াল রাখেন না। তাই অনেকক্ষেত্রে শিশুদের ওজন অতিরিক্ত থাকে। এ কারণেই এগিয়ে আসছে বয়ঃসন্ধি। এছাড়া মায়ের যদি পিরিয়ড তাড়াতাড়ি শুরু হয়ে থাকে, তার মেয়ের ক্ষেত্রেও সেটা হতে পারে’। 

ক্রমশ এগিয়ে আসছে পিরিয়ড শুরুর সময়, বলছে গবেষণা 

২০২৪ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ৭১ হাজার ৩৪১ জন আমেরিকান নারীর ওপর পিরিয়ড শুরুর সময় নিয়ে একটি গবেষণা করে। এসব নারীদের জন্ম ১৯৫০ সাল থেকে ২০০৫ এর মধ্যে। এতে দেখা যায় পাঁচ দশক ধরে মেয়েদের প্রথম মাসিক 'তাড়াতাড়ি' বা 'খুব তাড়াতাড়ি' হওয়ার হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। 

এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে যেসব নারীর জন্ম ১৯৫০-১৯৬৯ এর মধ্যে তাদের পিরিয়ড শুরুর গড় বয়স ১২.৫। অন্যদিকে ২০০০-২০০৫ সালে জন্ম নেওয়াদের ক্ষেত্রে পিরিয়ড শুরুর গড় বয়স নেমে এসেছে ১১.৯ বছরে। 

period5

বয়সের এই হার সময়ের সঙ্গে আরও কমছে। আমেরিকার তুলনায় যা এশিয়ায় বেশি স্পষ্ট। কেবল পিরিয়ড শুরুর বয়স যে আগাচ্ছে তা নয়, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অনিয়মিত পিরিয়ডের হারও। 

কেন এগিয়ে আসছে পিরিয়ড শুরুর সময়? 

স্থূলতা এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। কেননা শরীরে জমা ফ্যাট ইস্ট্রোজেনের ক্ষরণ ঘটায়। ফলে মেয়েদের স্তনের বিকাশ ঘটে এবং পিরিয়ড শুরু হয়। এজন্য আবার দায়ী ফাস্টফুড। বর্তমান প্রজন্ম মুখরোচক সব ফাস্টফুডে আসক্ত। এতে শরীরে পুষ্টির অভাব হচ্ছে। বাড়ছে ফ্যাটের স্তর। ফলে মেয়েদের মধ্যে পিরিয়ড শুরুর সময় এগিয়ে আসছে। 

এছাড়াও পরিবেশের কারণেও এমনটা হচ্ছে। প্লাস্টিক, পার্সোনাল কেয়ার প্রোডাক্ট এবং ফুড প্যাকেজিংয়ে থাকা নানা রাসায়নিক শরীরে হরমোনের তারতম্য সৃষ্টি করছে। ফলে বয়ঃসন্ধি এগিয়ে আসছে।

period6

বর্তমানে পড়াশোনার ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপের কারণেও মেয়েদের পিরিয়ড শুরুর বয়স এগিয়ে আসছে। স্ট্রেসের কারণে কর্টিসলের ক্ষরণ বাড়ছে। আর এই হরমোনের তারতম্যের প্রভাব পড়ছে বয়ঃসন্ধিতে।

এক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ারও কিছুটা প্রভাব রয়েছে। বর্তমানে শিশুরা সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা কনটেন্ট দেখে বেড়াচ্ছে। সিনেমা, গান দেখে। এর মধ্যে কিছু কনটেন্ট, দৃশ্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উপযুক্ত থাকে। যা পরোক্ষভাবে শিশুর বয়ঃসন্ধি এগিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। 

পিরিয়ডের সময় এগিয়ে আসায় কি ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হতে পারে? 

হ্যাঁ। কিছুটা সমস্যা তো হবেই। এই যেমন পিরিয়ড শুরুর সময় যত এগিয়ে আসছে, পিরিয়ড বন্ধ বা মেনোপজের সময়ও তত এগিয়ে আসছে। সমীক্ষা বলছে, যেসব নারীদের ১১ বছর বয়সের আগেই পিরিয়ড শুরু হয় তাদের বয়স ৪০ এর আগেই মেনোপজের লক্ষণ দেখা দেয় এবং ৪০ থেকে ৪৪ বছর বয়সের মধ্যেই তাদের মেনোপজ হয়ে যায়। স্বাভাবিক নিয়মে এই প্রক্রিয়া ৪৫-৫৫ বছর বয়সে ঘটত। 

period7

মেনোপজ এগিয়ে আসার বিষয়টি সন্তান গ্রহণের সময়সীমা হ্রাসেরও ইঙ্গিত দেয়। বর্তমানে নারীরা শিক্ষা ও ক্যারিয়ারের বিষয়ে ভীষণ সচেতন। পড়াশোনা শেষ করে চাকরিজীবনে প্রবেশ করে এরপর সংসার বা সন্তান নেওয়ার ব্যাপার নিয়ে ভাবেন তারা। ২৫-৩০ বছর বয়সে গিয়ে এই প্রজন্মের বেশিরভাগ নারী সন্তান গ্রহণের পরিকল্পনা করে। ওদিকে ৪০ এ মেনোপজ হলে ৩০ এর পরই দেখা দেয় নানা জটিলতা। ফলে ক্রমশ জটিল হচ্ছে সন্তান গ্রহণ প্রক্রিয়া। অনেক নারী হারাচ্ছেন মাতৃত্বের স্বাদও।  

গবেষণায় দেখা গেছে পিরিয়ডের সময় এগিয়ে আসায় বাড়ছে হৃদরোগের ঝুঁকি। স্থূলতা, মিসক্যারেজ (গর্ভপাত), অকাল মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে এটি। সেসঙ্গে বাড়ছে জরায়ু ক্যানসার, এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যানসার ও ব্রেস্ট ক্যানসারের ঝুঁকি। পিরিয়ডের সময় এগিয়ে আসার পাশাপাশি দ্রুত গতিতে বাড়ছে পিসিওএস সমস্যা। এটি মূলত জরায়ুতে হওয়া সিস্টকে বোঝায় যা অনিয়মিত পিরিয়ডের জন্য দায়ী। পিসিওএস থাকলে সন্তান ধারণ প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে পড়ে। 

আরও পড়ুন- 
 
 
 

অভিভাবক হিসেবে করণীয়

পিরিয়ড শুরুর বয়স এগিয়ে আসার মানে হলো অভিভাবকদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে। শিশু যেন ব্যাপারটিকে সহজভাবে গ্রহণ করে, ভয় না পায় তা নিশ্চিত করুন। তার বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করুন। শিশুর খাদ্যতালিকায় স্বাস্থ্যকর খাবার রাখুন। প্রচুর ফল ও শাক-সবজি খাওয়ান। পাশাপাশি শারীরিক কার্যকলাপও জরুরি। শিশুর পর্যাপ্ত ঘুমও নিশ্চিত করুন। 

period8

অনেকসময় শিশুর প্রস্রাবের সঙ্গেও রক্ত বের হতে পারে যা আসলে পিরিয়ড নয়। মূত্রনালীর সংক্রমণ, কিডনিজনিত সমস্যা, রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা, শারীরিক আঘাতের কারণে এমনটা হতে পারে। প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বের হলে দ্রুত একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন। 

সময় এগিয়ে চলছে নিজ গতিতে। পৃথিবীতে অনেক বিষয়েই আসছে পরিবর্তন। পিরিয়ড শুরুর সময় এগিয়ে আসাও তেমন একটি বিষয়। দুশ্চিন্তায় না ভুগে এ ব্যাপারে সচেতন থাকুন। সন্তানকে শারীরিক পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত রাখুন। তার চারপাশের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করুন।

তথ্যসূত্র: এবিপি, এনপিআর, ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক, উইকি ইত্যাদি

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর