শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ খাদ্যনালী। আমরা যা খাই তা গলা থেকে পেটে নিয়ে যাওয়ার কাজ করে এই নালী। খাদ্যনালীর সমস্যা হলে তার প্রভাব পড়ে পুরো শরীরে। খাদ্যনালীর সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যাসিড রিফ্লাক্স এবং জিইআরডি। বুক জ্বালাপোড়া, বুকের মাঝখানে যন্ত্রণা ও জ্বালা করা মূলত এই নালীর সমস্যার কারণেই হয়।
খাদ্যনালী কী? এর কাজ কী, কীভাবেই বা কাজ করে? খাদ্যানালীর দৈর্ঘ্য কত? খাদ্যানালীতে কী কী সমস্যা হয়? –সব প্রশ্নের উত্তর জানুন এই প্রতিবেদনে।
বিজ্ঞাপন
খাদ্যনালী কী?
খাদ্যনালী হলো শ্বাসনালীর পেছনে অবস্থিত একটি ফাঁপা, পেশীবহুল নল। এটি গলা থেকে খাদ্য ও তরল পদার্থ পেটে পৌঁছে দেয়। খাদ্যনালী পাচনতন্ত্রের অংশ হিসেবে কাজ করে।

খাদ্যনালী কী করে?
বিজ্ঞাপন
খাদ্যনালীর প্রাথমিক কাজ হলো মুখ থেকে খাদ্য এবং তরল পদার্থ বহন করে পাকস্থলীতে নিয়ে যাওয়া। খাবার গিলে ফেলার পর খাদ্য এবং তরল পদার্থ প্রথমে মুখ থেকে গলায় (ফ্যারিনক্স) চলে যায়। তখন এপিগ্লোটিস নামক একটি ছোট পেশীবহুল স্তর বন্ধ হয়ে যায় যা খাদ্য এবং তরল পদার্থকে “ভুল নল (শ্বাসনালী)” দিয়ে প্রবেশে বাধা দেয়। ইউভুলা নামক আরেকটি ছোট স্তর তরল পদার্থকে নাকের গহ্বরে উপরের দিকে যেতে বাধা দেয়।
খাদ্যনালী কীভাবে কাজ করে?
খাদ্যনালীর উপরের খোলা অংশে স্ফিঙ্কটার নামে একটি বলয় আকৃতির পেশী থাকে। খাদ্যনালী দিয়ে খাবার বা তরল আসার সংকেত পেলে এই স্ফিঙ্কটার শিথিল হয়ে যায় বা খুলে যায় যাতে খাবার খাদ্যনালীর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। যখন কোনো খাদ্য বা তরল খাদ্যনালীতে প্রবেশ করে না, তখন এটি বন্ধ থাকে।
খাদ্যনালীর ভেতর খাবার প্রবেশ করলে, পেশী সংকোচনের তরঙ্গ (পেরিস্টালসিস) খাবারকে নিচের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে খাবার ডায়াফ্রামের মধ্য দিয়ে যায় এবং নিম্ন খাদ্যনালীতে পৌঁছায়।

নিম্ন খাদ্যনালীর খোলা অংশে, নিম্ন খাদ্যনালীর স্ফিঙ্কটার (LES) নামে আরেকটি বলয় আকৃতির পেশী থাকে। উপরের খাদ্যনালীর স্ফিঙ্কটার (UES) এর মতো এটিও খাদ্য এবং তরল কখন আসছে তা অনুভব করে। এই অংশে খাবার এলে অংশটি শিথিল হয়ে যায় এবং খাবারকে আপনার পেটে যেতে দেয়। যখন কোনো খাবার বা তরল এই পথে আসে না, তখন এটি সাধারণত বন্ধ থাকে। ফলে পেটের অ্যাসিড এবং পাচক রস খাদ্যনালীতে প্রবেশ করে না।
খাদ্যনালী কোথায় অবস্থিত?
খাদ্যনালী বুকের মাঝখানে মিডিয়াস্টিনাম নামক একটি অঞ্চলে অবস্থিত। এর অবস্থান শ্বাসনালীর পেছনে এবং মেরুদণ্ডের সামনে।
খাদ্যনালীর দৈর্ঘ্য কত?
প্রাপ্তবয়স্কদের খাদ্যনালী গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১৩ ইঞ্চি লম্বা হয়। এর ক্ষুদ্রতম বিন্দুতে এটি প্রায় এক ইঞ্চির তিন-চতুর্থাংশ পুরু হয়ে থাকে।

শ্বাসনালী এবং খাদ্যনালীর মধ্যে পার্থক্য কী?
শ্বাসনালী আর খাদ্যনালী দুটোই একই স্থানে অবস্থিত। তবে দুটি নলের কাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। শ্বাসনালী মূলত শ্বাসযন্ত্রের অংশ আর খাদ্যনালী পাচনতন্ত্রের অংশ। শ্বাসনালী ফুসফুসের ভেতরে ও বাইরে বাতাস পরিবহন করে। অন্যদিকে খাদ্যনালী গলা থেকে পেটে খাদ্য এবং তরল পরিবহন করে।
খাদ্যনালীতে কোন কোন সমস্যা হয় এবং এটি কী প্রভাব ফেলতে পারে?
খাদ্যনালীতে সবচেয়ে সাধারণ যে সমস্যাটি দেখা দিতে পারে তা হলো অ্যাসিড রিফ্লাক্স। যখন নির্ধারিত সময় ছাড়াও নিম্ন খাদ্যনালী স্ফিঙ্কটার খোলা থাকে তখন অ্যাসিড রিফ্লাক্স হয়। এটি পেটের অ্যাসিড এবং পাচক রসকে পেট থেকে খাদ্যনালীতে ফিরিয়ে আনে। ফলে প্রদাহ এবং বুক জ্বালাপোড়া দেখা দেয়।
অ্যাসিড রিফ্লাক্সের আরও গুরুতর রূপ হলো গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD)। জিইআরডি’র ক্ষেত্রে, পাকস্থলীর অ্যাসিড ক্রমাগত খাদ্যনালীতে ফিরে যেতে থাকে। এতে বুক জ্বালাপোড়ার পাশাপাশি কাশি, বুকে ব্যথা, স্বরভঙ্গ, মুখের দুর্গন্ধের মতো সমস্যা দেখা দেয়। দীর্ঘদিন এই সমস্যা থাকলে খাদ্যনালীর মারাত্মক সমস্যা হতে পারে।

খাদ্যনালীকে প্রভাবিত করতে পারে এমন আরও কিছু সমস্যা হলো-
অ্যাকালাসিয়া: এটি এমন একটি বিরল ব্যাধি যা হলে নিম্ন খাদ্যনালীর স্ফিঙ্কটার যখন খোলার সময় তখন খোলে না। এটি পেটে খাবার প্রবেশ করতে বাধা দেয়।
খাদ্যনালীর ডাইভার্টিকুলাম: এটি এমন একটি থলি যা খাদ্যনালীর আস্তরণের একটি দুর্বল অংশে বাইরের দিকে ফুলে ওঠে। ডাইভার্টিকুলাম বাধা সৃষ্টি করলে রোগী গিলতে অক্ষম হতে পারেন।
খাদ্যনালীর বৃহৎ শিরা: এটি খাদ্যনালীর আস্তরণের ওপর অবস্থিত বড় বা ফোলা শিরা। শিরাগুলো ভেঙে রক্তপাত হলে তা মারাত্মক হতে পারে।

খাদ্যনালীর প্রদাহ: অ্যাসিড রিফ্লাক্স, সংক্রমণ, বমি, কিছু ওষুধ বা রেডিয়েশন চিকিৎসা খাদ্যনালীর প্রদাহের কারণ হতে পারে।
ইওসিনোফিলিক খাদ্যনালী প্রদাহ: খাদ্যনালীতে ইওসিনোফিল নামক কিছু শ্বেত রক্তকণিকা জমা হওয়ার ফলে এই ধরণের খাদ্যনালী প্রদাহ হয়। খাবারের অ্যালার্জির কারণেও খাদ্যনালীতে ইওসিনোফিল জমা হতে পারে।
ব্যারেটের খাদ্যনালী: নিম্ন খাদ্যনালীর আস্তরণের টিস্যুতে পরিবর্তন এটি। দীর্ঘমেয়াদী (দীর্ঘস্থায়ী) জিইআরডি এই পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। এই সমস্যাটি খাদ্যনালীতে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

খাদ্যনালীর সমস্যার লক্ষণ কী কী?
খাদ্যনালীর সমস্যার সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি হলো বুক জ্বালাপোড়া। সাধারণত বুকের মাঝখানে ও পেছনের অংশে এই জ্বালাপোড়ার অনুভূতি হয়।
খাদ্যনালীর সমস্যার আরও কিছু উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হলো-
গিলতে অসুবিধা (ডিসফ্যাজিয়া)
বুকে ব্যথা
রিগারজিটেশন (খাদ্য খাদ্যনালী থেকে মুখে ফিরে আসে)
গলার পেছনে খাবার আটকে থাকার অনুভূতি
কাশি
গলায় স্বরভঙ্গ বা গলা ব্যথা
বমি বা রক্ত বমি করা
মুখের দুর্গন্ধ (হ্যালিটোসিস)
ওজন হ্রাস
খাদ্যনালী শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর যত্ন নিন। খাদ্যনালীর কোনো সমস্যা হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
এনএম

