আমেরিকায় আসার পর থেকে ‘বোবা টি’র কথা খুব শুনতাম। নামটা প্রথম কার মুখে শুনেছিলাম মনে নেই। সবার ভীষণ পছন্দের এই চা-এইটুকুই জানতাম। কোথায় এটা পাওয়া যায়, বোবা চা কী জিনিস-সে বিষয়ে ধারণা ছিল না।
আমার মাদাগাস্কারের বন্ধু অ্যান্ডির কাছে প্রথম জানতে পারি, গেটিসবার্গ শহরের একটা এশিয়ান রেস্টুরেন্টে বোবা চা পাওয়া যায়। ভাবলাম, একবার চেখে দেখতে হবে কী এই জিনিস, যার জন্য এখানে সবাই এত ব্যস্ত হয়ে থাকে। ভাবনা মতো এক বিকেলে চলে গেলাম জে অ্যান্ড জে এশিয়ান রেস্টুরেন্টে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে যেমন চা বলতে আমরা প্রধানত বুঝি চা গাছের পাতা থেকে তৈরি পানীয়, এখানে ব্যাপারটা তেমন না। আপনি চা চাইলে আপনাকে নির্দিষ্ট করে বলে দিতে হবে আপনি কীসের চা চান। যেকোনো ফুল, ফল বা পাতা থেকে তৈরি পানীয়কেই এখানে চা বলা হয়।
জে অ্যান্ড জে রেস্টুরেন্টে গিয়ে তাই ওদের চায়ের লম্বা তালিকা দেখে অবাক হলাম না। ফ্রুট টি বা ফলের চা আর মিল্ক টি (মূলত বিভিন্ন ফ্রুট টি-এর সঙ্গে দুধ মেশানো)- এই দুই ধরনের বাবল টি বা বোবা টি আছে ওদের। এই দুই ধরনের মধ্যে আবার বিভিন্ন ফ্লেভার আছে-লিচু, স্ট্রবেরি, পিচ, আম, টারো, হানিডিউ ইত্যাদি।
আমরা দুই বন্ধু গিয়েছিলাম। একজন নিলাম একটা লিচু ফ্রুট টি, অন্যজন নিলাম স্ট্রবেরি মিল্ক টি।
যে ড্রিংকটা পেলাম, তার সঙ্গে আমাদের দেশের চায়ের কোনো সাদৃশ্য নেই। বরফ কুচি দিয়ে অর্ধেক কাপ ভর্তি করা ঠাণ্ডা একটা পানীয়। কাপের তলায় অনেকগুলো কালো রঙের ছোট ছোট বল। কাপের সঙ্গে বেশ মোটা একটা স্ট্র দেয়া যেন চুমুক দিলে চায়ের সঙ্গে বলগুলোও উঠে আসে।
এই কালো বলগুলোই মূলত বোবা বা বাবল, যেটা বোবা চায়ের মূল বৈশিষ্ট্য।
বিজ্ঞাপন
এই কালো বলগুলোর আসল নাম ট্যাপিওকা পার্ল। ট্যাপিওকা নামক এক ধরনের স্টার্চ থেকে তৈরি করা হয় ট্যাপিওকা পার্ল। প্রধানত কালো রঙের ট্যাপিওকা বল হলেও এশিয়ানরা বিভিন্ন স্বাদের এবং বিভিন্ন রঙের ট্যাপিওকা পার্ল তৈরি করে থাকে বিভিন্ন ধরনের খাবার বা পানীয়তে ব্যবহারের জন্য। তবে বোবা টি-তে সাধারণত কালো ট্যাপিওকা পার্লই ব্যবহৃত হয়, যদিও গ্রিন পার্ল মিল্ক টি নামে এক ধরনের জনপ্রিয় বোবা চা আছে যেটাতে সবুজ ট্যাপিওকা পার্ল ব্যবহৃত হয়।
বোবা চায়ের উৎপত্তি তাইওয়ানে। সর্বপ্রথম যে বোবা চায়ের কথা জানা যায়, সেটা ছিল গরম তাইওয়ানিজ ব্ল্যাক টি, ট্যাপিওকা পার্ল, কনডেন্সড মিল্ক আর মধু বা সিরাপ দিয়ে তৈরি চা। পরবর্তীতে নানা স্বাদের গরম এবং ঠাণ্ডা দুই ধরনেরই বোবা চায়ের প্রচলন ঘটে। এখন অবশ্য বরফ মেশানো ঠাণ্ডা বোবা চা-ই জনপ্রিয়, এবং এটাই সব জায়গায় পাওয়া যায়।
বোবা চায়ের উৎপত্তি নিয়ে দুটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে। কেউ কেউ ধারণা করেন, বোবা চা প্রথম তৈরি করে তাইওয়ানের তাইচুং শহরের চুন শুই তাং টি রুম। ১৯৮৮ সালে এই কোম্পানির একটা মিটিংয়ে একজন কর্মী তার চায়ে ট্যাপিওকা বল মেশান এবং অন্যদেরকেও সেটা করতে উদ্বুদ্ধ করেন। আরেকটা প্রচলিত গল্প হচ্ছে, ১৯৮৬ সালে তাইনান শহরের হানলিন টি রুম প্রথম বোবা চা তৈরি করে।
উৎপত্তি যেভাবেই হয়ে থাকুক, বোবা চা অল্প সময়ের মধ্যেই সবার মন জয় করে নেয়। পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বোবা চা খুব দ্রুত হয়ে ওঠে জনপ্রিয় পানীয়।
তাইওয়ানে বোবা চা শুধু একটা পানীয়ের মধ্যেই আর সীমাবদ্ধ নেই, এটা এখন তাইওয়ানের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতীক। বোবা চা তাইওয়ানের ইতিহাসে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে ২০২০ সালে ৩০ এপ্রিলকে জাতীয় বোবা চা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, একই বছরে তাইওয়ানের পাসপোর্টের কাভারের নকশা হিসেবে বোবা চায়ের ছবি দেয়ার প্রস্তাবনা আসে।
এ তো গেল বোবা চায়ের এশিয়া জয়ের গল্প। কিন্তু আমেরিকানরা কীভাবে বোবা চায়ের প্রেমে পড়ল? কেনই বা ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল মলের মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ থেকে শুরু করে পেনসিলভানিয়ার ছোট্ট একটা শহর-সব জায়গায় বোবা চায়ের জন্য রীতিমতো আলাঅ্যা দোকান আছে, আর সেই দোকানগুলোতে প্রতিদিন এত ভিড় লেগে থাকে?
কীভাবে আমেরিকায় এল বোবা চা?
বোবা চা আসলে আমেরিকায় এসেছে তাওয়ানিজদের হাত ধরেই। তাইওয়ান থেকে আমেরিকায় আসা অভিবাসীরা নব্বইয়ের দশকে প্রথম আমেরিকায় বোবা চায়ের দোকান খোলে। ক্যালিফোর্নিয়ার কিউপার্টিনো শহরে খোলা সেই দোকানের নাম ছিল ফ্যান্টাসিয়া কফি অ্যান্ড টি। সেই থেকে খুব দ্রুত আমেরিকানদের মন জয় করে নেয় বোবা চা। আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এই পানীয়। এশিয়ান আমেরিকানদের কাছে এটা শুধু পানীয় নয়, হয়ে ওঠে আমেরিকায় তাদের পরিচয়। বাবল টি আমেরিকায় এসে পায় আদুরে নাম `বোবা'। বর্তমানে বোবা শুধু আমেরিকায় এশিয়ান সংস্কৃতির প্রতীক নয়, দেশ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে প্রায় সবার প্রিয় পানীয়।
এই যে আমার কথাই ধরুন না। সেই প্রথমবার বোবা চা পান করার পর থেকে এখন পর্যন্ত পরীক্ষা ভালো হওয়ার আনন্দ, পরীক্ষা খারাপ হওয়ার হতাশা, পড়ার চাপ, ছুটির দিন-যেকোনো অজুহাতে সপ্তাহে একদিন বোবা আমার লাগবেই!
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গ কলেজের শিক্ষার্থী
এজেড

