শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ভোগান্তির আরেক নাম ‘চেকের মামলা’, দুই ডেটেই বছর পার

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ১২ আগস্ট ২০২৫, ১০:১৫ পিএম

শেয়ার করুন:

court
চেকের মামলায় বছরের পর বছর ঘুরছে ভুক্তভোগীরা। ছবি: সংগৃহীত

সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক থেকে ব্যবসার জন্য ঋণ নিয়েছিলেন খুলনার মুক্তা খাতুন। তবে করোনা মহামারির ধাক্কায় ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় তিনি সেই ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। তিনি খুলনা থেকে ঋণ নিলেও ব্যাংক তার বিরুদ্ধে মামলা করে ঢাকায়। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ আমলি আদালতে দায়ের করা সিআর মামলাটিতে হাজিরা দিতে এই নারী খুলনা থেকে নিয়মিত আসেন। তবে প্রায় পাঁচ বছর আগে দায়ের করা মামলাটি এখনো সাক্ষ্য পর্যায়েই রয়েছে। এটি কবে নিষ্পত্তি হবে সেটা তিনি যেমন জানেন না, তেমনি জানেন না আদালত সংশ্লিষ্টরাও।

আদালতপাড়ায় এ ধরনের ভুক্তভোগী শুধু আসামিই নয়, বাদীও। একটি চেকের মামলার বাদী মনজুরুল হক। ২০১৭ সালে তার ফাইল করা মামলাটি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। তিনি প্রতিটি ধার্য তারিখে আদালতে আসেন। নিয়মিত হাজিরা দেন। এরপর অপেক্ষা করতে হয় নতুন তারিখের জন্য। দীর্ঘ সময়েও বিচার শেষ না হওয়ায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই ভুক্তভোগী।


বিজ্ঞাপন


আদালত সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতে নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টস অ্যাক্ট-১৮৮১ (চেক প্রত্যাখ্যান) মামলার বিচার হয় আটটি যুগ্ম আদালতে। এসব আদালতে বর্তমানে এক লাখ ২০ হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন। প্রতিটি আদালতে ১৫ থেকে ১৭ হাজার মামলা চলমান। প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ২৫০টি মামলার নথি শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হয়। এসব আদালত শুধু চেকের মামলা নয়, অন্য মামলার শুনানিও পরিচালনা করেন। তবে বেশির ভাগ মামলাই চেকসংক্রান্ত। আর চেকের মামলা যেন ভোগান্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব মামলায় বছরে দুটির বেশি তারিখ পড়ে না। ফলে বছরের পর বছর ঘুরতে হয় এসব মামলায় বিচার পেতে।  

চেকের মামলায় এত দীর্ঘসূত্রিতার কারণ হিসেবে ঢাকা জজ কোর্টে নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন এমন একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা মেইলের। তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে জানান, মূলত চেকের মামলা আপসযোগ্য, কিন্তু বাদী-বিবাদী ও আইনজীবী কারণেই এসব মামলা শেষ করতে সময় লাগে আদালতের। সিএমএম কোর্টে মামলা দায়ের হওয়ার পর দ্রুতই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু মামলার দীর্ঘসূত্রিতা বাড়ে মহানগর আদালতে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সানজিদ সিদ্দিকী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘চেকের মামলা নিয়ে চলমান সমস্যা সমাধানে বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। আদালতের সংখ্যাও বাড়ানো দরকার। এসব মামলায় বিচার করেন যুগ্ম দায়রা আদালত। এমন বিচারকের সংকট রয়েছে। স্বল্পসংখ্যক বিচারক দিয়ে এত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়।’


বিজ্ঞাপন


এই আইনজীবী বলেন, ‘আমাদের লেনদেনের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হওয়া উচিত। লেনেদেনের বিষয়ে এক সময় চুক্তি ভঙ্গ হয়। এ কারণে মামলাও হয়। পরে এজন্য ভুক্তভোগীরা চিন্তা করে তারা মামলার টাকা তুলবে কীভাবে। যার কারণে লেনদেনের সময় চেক রেখে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে চুক্তি ভঙ্গ হলে চেকের মামলা দেওয়া হয়।’  

চেকের বিষয়ে হাইকোর্টে অনেক মামলা বিচারাধীন আছে। চেকের মামলা কমাতে বা দ্রুত সমাধানে আসতে হলে এ বিষয়ে হাইকোর্টের একটি গাইড লাইন থাকা উচিত বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা।

আরও পড়ুন

তিন প্রজন্মকে আর টানতে হবে না দেওয়ানি মামলার ঘানি!

মামলার জট কমাতে সরকারি উদ্যোগে আশার আলো

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এমএ জলিল উজ্জ্বল ঢাকা মেইলকে বলেন, চেকের মামলা দায়ের হয় চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। মহানগরে নয়। এরপর আসামি আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন। জামিন নিলে মামলাটি অন্য আদালতে চলে যায় বিচারের জন্য। কেউ সমন ওয়ারেন্টসহ নানা ধাপ পার হলেও কোর্টে না এলে আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এরপর মামলার কাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। এখানে সময় লাগে। তবে সব মামলার ক্ষেত্রে এরকম হয় না। কিছু ব্যতিক্রমও আছে। এটা নির্ভর করে মামলার বাদী-বিবাদী ও আইনজীবীর ওপর। তাদের সক্রিয় পদক্ষেপটা জরুরি।’

Case22
মামলা জট দিন দিন শুধু বাড়ছেই। ছবি: সংগৃহীত

সংশ্লিষ্টরা জানান, সিএমএম আদালত থেকে মামলা বদলি হয়ে গেলে মহানগর আদালতে এর বিচার কাজ করতে সময় লাগে বেশি। মহানগর আদালতে এক মামলায় দুটি তারিখ নিলেই এক বছর পার হয়ে যায়। বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতি দূর করতে আইনজীবীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তারা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. খাদেমুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় এসব বিষয় নিয়ে আদালতের সেরেস্তায় গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাদের বলেন, চেকের মামলার পরিমাণ ঢাকার আদালতে বেশি। যথেষ্ট পরিমাণ কোর্ট নেই। যার কারণে মামলার পরবর্তী ডেট পেতে সময় লাগে।’

আরও পড়ুন

আদালতপাড়ায় বকশিশের নামে উৎকোচের রাজত্ব!

মামলা জটে বিপর্যস্ত বিচার বিভাগ, নথি সংরক্ষণে হিমশিম

এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘ঢাকার সিএমএম আদালতে চেকের মামলার ডেট পেতে বেশি সময় লাগে না। সময় বেশি লাগে মূলত মহানগর আদালতে গিয়ে। এজন্য মামলা নিষ্পত্তিতে সময় বেশি লাগছে। তবে কোর্ট বাড়িয়ে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ না নিলে ঢাকার আদালতগুলোতে চেকের মামলার পরিমাণ দিন দিন বাড়তেই থাকবে।’

সূত্র জানায়, ঢাকার প্রথম যুগ্ম আদালতে ১৬ হাজার ৬৯০টি, দ্বিতীয় যুগ্ম আদালতে ১৪ হাজার ৮৬৬টি, তৃতীয় যুগ্ম আদালতে ১৭ হাজার ২৬৯টি, চতুর্থ যুগ্ম আদালতে ১৩ হাজার ৮৪৪টি, পঞ্চম যুগ্ম আদালতে ১৬ হাজার ৯৩টি, ষষ্ঠ যুগ্ম আদালতে ১৭ হাজার ২০৬টি, সপ্তম যুগ্ম আদালতে ১৪ হাজার ৮৮৯টি এবং পরিবেশ আদালতে ১০ হাজারের বেশি চেক ডিসঅনার মামলা বিচারাধীন।

এসব মামলা ধাপে ধাপে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তরিত হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই শুধু ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে ১২ হাজার নতুন মামলা এসেছে বিচারের জন্য। তবে প্রতি বছর নতুন মামলা আসার সংখ্যা নিষ্পত্তিকৃত মামলার চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় মামলার জট ক্রমেই বাড়ছে।

ঢাকার সপ্তম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এ কোর্টে চেকসংক্রান্ত মামলার সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার। এর মধ্যে ১৫ বছর আগের মামলাও রয়েছে।

মামলার সংখ্যা বেশি হওয়ায় বছরে একটি শুনানির তারিখ পাওয়াই কঠিন। গড়ে ১০ থেকে ১১ মাস পর একটি মামলার তারিখ আসে। আদালতের সংখ্যা কম ও পর্যাপ্ত কর্মচারী না থাকায় মামলার নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

এআইএম/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর