এদেশের রাজনীতিতে মিথ্যা মামলার প্রচলন বহুকালের পুরনো। যখন যারা ক্ষমতায় থাকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে পাইকারি হারে মামলা দেয়। এর বেশির ভাগ মামলাই মিথ্যা। আবার সরকার পরিবর্তনের পর সেসব মামলা রাতারাতি প্রত্যাহার করা হয়। আওয়ামী লীগ টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা দিয়ে বিরোধীদের ঘায়েল করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার ২০ হাজার মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের এই উদ্যোগকে আইনজ্ঞরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে তারা বলছেন, মামলাগুলো যেন যথাযথ যাচাই-বাছাই করে প্রত্যাহার করা হয়। মিথ্যা মামলার ঘোরটোপে যেন সত্যিকারের কোনো অপরাধী পার না পেয়ে যায়। এতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা কমবে।
বিজ্ঞাপন
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মিথ্যা মামলার জন্য বিচার বিভাগ আগেও বিতর্কিত হয়েছে। মিথ্যা মামলা বিচার বিভাগকে বিতর্কের মুখে ফেলে। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি অলরেডি হয়ে গেছে।’
এই আইনজ্ঞ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে বহু মিথ্যা মামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বলেছিল ৬-৭ হাজার মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু সরকার সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এখন সরকার বলছে ২০ হাজার মামলা প্রত্যাহার করা হবে। প্রধান উপদেষ্টা তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করার পর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখন মিথ্যা ও রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য যেসব মামলা প্রত্যাহার করা হচ্ছে, সেটা যেন সত্যিই মিথ্যা মামলা হয়। এই মামলাগুলো যেন যাচাই-বাছাই করে প্রত্যাহার করা হয়। এমনটি যেন না হয় যে, রাজনীতি করলে তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহার হয়ে যাচ্ছে। এটা আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার পরিপন্থী। এরকম হলে আইনের শাসন ব্যাহত হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সানজিদ সিদ্দিকী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সরকার মিথ্যা বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাগুলো প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব মামলা তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে মামলার অভিযোগ দেখতে হবে। সত্যি করে এসব মামলা যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে। রাজনৈতিকভাবে যেসব মামলা করা হয়েছে সেগুলো প্রত্যাহার করা যেতে পারে। কিন্তু এর ফলে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থেকে যেসব মামলা হয় সেগুলো তুলে নেওয়া মোটেও ঠিক হবে না।’
তার মতে, সরকারকে সাবধানতা বজায় রাখতে হবে। যাতে করে মিথ্যা মামলার নামে রাজনৈতিক মামলার নামে হত্যা বা অপহরণ বা গুরুতর অপরাধের মামলাগুলো প্রত্যাহার করা না হয়। এরকম করা হলে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হবে। মানুষ ন্যায়বিচার বঞ্চিত হবে। প্রকৃত অপরাধীরা তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।
সিরাজগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) শাকিল মোহাম্মদ শরিফুর হায়দার (রফিক সরকার) বলেন, মিথ্যা ও রাজনৈতিক মামলা হিসেবে আমরা এই জেলা থেকে ৮৮৫টি মামলার তালিকা পাঠিয়েছিলাম। তার মধ্য থেকে ৬৪৭টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রথমে আমি এসব মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করি সরকারের কাছে। সেগুলো সরকার পাঠায় জেলা জজের কাছে। উনি এসব মামলা দেখে যাচাই-বাছাই করে আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর অফিসে পাঠান। পরে আমাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়। তবে মাদক, হত্যা, নারী নির্যাতন, অস্ত্র মামলাগুলো প্রত্যাহার হয়নি। বাকিগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে।
জানা গেছে, সারাদেশে দায়ের হওয়া শত শত মামলা প্রত্যাহার করছে সরকার। সম্প্রতি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমি মনে করি, মন্ত্রণালয় আগামী ছয় মাসে কমপক্ষে ২০ হাজার মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করবে।’
উপদেষ্টা বলেন, ‘সরকার মিথ্যা বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহারের একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ইতোমধ্যেই প্রায় ১২ হাজার মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে, যা কমপক্ষে তিন লাখ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে।’
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি ২৮ মে পর্যন্ত ১৬টি বৈঠকে ১১ হাজার ৪৪৮টি রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছে এবং এ বিষয়ে আরও কাজ চলছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জেলা পর্যায়ের কমিটি ও আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর শাখা প্রেরিত তালিকা ও সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনা করে কমিটি রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করছে।
এআইএম/জেবি

