রাজধানীর পূর্বাচল নিউ টাউন প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ-সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা তিনটি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা এবং শেখ রেহানার দুই মেয়ে—ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে ঢাকার একটি আদালত।
রোববার (১৩ এপ্রিল) ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক এই আদেশ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দাখিল করা অভিযোগপত্র গ্রহণ করার পর আদালত এই চারজনকে ‘পলাতক’ হিসেবে উল্লেখ করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন।
বিজ্ঞাপন
এর আগে, গত বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) একই প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় শেখ হাসিনা, তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আদালত। সেই মামলাতেও জারি করা হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা।
তবে, ব্রিটিশ নাগরিক ও যুক্তরাজ্যের সাবেক নগরমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন।
ব্রিটিশ দৈনিক ডেইলি মেইল এক প্রতিবেদনে জানায়, টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে দায়ের করা মামলাটি আদালতের বিবেচনায় আসার পর তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতে পারে—এমন আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, যদি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় এবং টিউলিপ আত্মসমর্পণ না করেন, তাহলে তিনি আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে পলাতক আসামি হিসেবে বিবেচিত হবেন। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার চাইলে যুক্তরাজ্যের কাছে তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানাতে পারে।
টিউলিপ সিদ্দিক, যিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি, ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যের নগর মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও মিথ্যাচারের অভিযোগ ওঠার পর তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন।
বিজ্ঞাপন
ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে, টিউলিপ সিদ্দিক দীর্ঘদিন লন্ডনে একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন, যেটি নিয়ে তিনি ২০২২ সালে সংবাদমাধ্যমকে মিথ্যা তথ্য দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি দাবি করেছিলেন, ২০০৪ সালে তার বাবা-মা ফ্ল্যাটটি কিনে দিয়েছিলেন। তবে তদন্তে দেখা যায়, ওই ফ্ল্যাটটি কিনে দেওয়া হয় শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনদের মাধ্যমে, যা নিয়ে যুক্তরাজ্যে নৈতিক জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
প্লট বরাদ্দে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ
দুদকের অনুসন্ধান বলছে, পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর সড়কে ছয়টি প্লট বরাদ্দ নিতে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়। শেখ হাসিনার সুপারিশে তার বোন, ভাগ্নি ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে প্লট বরাদ্দ করা হয়। অথচ তারা রাজউকের প্লট বরাদ্দের শর্ত অনুযায়ী যোগ্য ছিলেন না।
এই ঘটনায় শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্য ছাড়াও মামলায় নাম এসেছে সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, তৎকালীন একান্ত সচিব সালাউদ্দিন আহমেদ এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ১৪ কর্মকর্তার। এখন পর্যন্ত এই দুর্নীতির ঘটনায় মোট ১৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে দুদক।
অভিযোগ ও আইনি ধারা
আসামিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, তারা ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ও দণ্ডবিধির ১৬১, ১৬৩, ১৬৪, ৪০৯ ও ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। মামলাগুলো ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দায়ের করা হয়।
এই মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রম এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে মামলাগুলো নতুন মাত্রা পেয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আইনজীবীরা বলছেন, যদি আসামিরা আত্মসমর্পণ না করেন, তবে আদালত পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে তাদের সম্পত্তি জব্দ বা দণ্ডাদেশ ঘোষণা করতে পারেন।
বিশ্লেষকদের মতে, একটি সংসার ও রাজনীতি– দুই জায়গাতেই প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের এভাবে দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে পড়া জনমনে গভীর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, এ মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ বিচারিক প্রক্রিয়া কোন দিকে মোড় নেয়।
এইউ