শুক্রবার, ৩ মে, ২০২৪, ঢাকা

সুপ্রিম কোর্ট বারে সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় দলীয় রাজনীতি

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ১৬ মার্চ ২০২৪, ০৩:২৩ পিএম

শেয়ার করুন:

সুপ্রিম কোর্ট বারে সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় দলীয় রাজনীতি
ছবি: সংগৃহীত

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ঘিরে বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না। গত তিন বছর যাবত আইনজীবীদের শীর্ষ এই সংগঠনের নির্বাচনের আগে বা পরে মারামারি-হাতাহাতি থেকে শুরু করে ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলায় জেল খেটেছেন দেশের নামকরা আইনজীবীরা। শিকার হয়েছেন নানা হয়রানির। এসব ঘটনা দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার খোরাকও জোগাচ্ছে।

দেশের বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের আইনজীবী সমিতির নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হলেও সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের ভোট নিয়ে এত অপ্রীতিকর কেন? তাহলে কি জেলা পর্যায়ের আইনজীবীদের নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিতে হবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের? এমন প্রশ্ন অনেকেরই।


বিজ্ঞাপন


আগের দুইবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটলেও এবার খোদ আওয়ামী সমর্থিত আইনজীবীদের মধ্যেই পদ-পদবী নিয়ে রক্তপাতের মতো সংঘর্ষ হয়েছে। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের মধ্যে বিভাজন প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। এমনকি শেখ পরিবারের প্রভাবশালী দুই সদস্য যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ এবং তার ছোট ভাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের অনুসারীরা এই দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। 

আরও পড়ুন

সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচনে ভাঙচুর-মারামারি, ৫ আইনজীবী গ্রেফতার

উচ্চ আদালতের আইনজীবীদের সমিতির নির্বাচন নিয়ে এত বিশৃঙ্খলা কেন সেই প্রশ্ন এখন আইনজীবীদের মুখে মুখে। সিনিয়র আইনজীবীদের মতে, বারকে দলীয়করণমুক্ত করতে হবে। তা না হলে ভবিষতে আরও খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হবে।

সুপ্রিম কোর্ট বারের ভোটে প্রভাব খাটাতে ডাকা হয়েছিল যুবলীগকে


বিজ্ঞাপন


এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছিলেন আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের স্ত্রী নাহিদ সুলতানা যুথী। তার পক্ষে প্রচারণা ও মহড়া দিতে ভোটের দিন সকাল থেকেই শত শত যুবলীগ কর্মী সাদা শার্ট পরে অবস্থান নিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে। গায়ে সাদা শার্ট আর গলায় যুথীর প্রচার কার্ড লাগিয়ে ভোটের মাঠে অবস্থান নেন তারা। সুপ্রিম কোর্ট বারের ভোটে এরকম চিত্র আগে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন বরাবর একঠি চিঠি পাঠান আওয়ামী লীগ সমর্থিত সম্পাদক পদপ্রার্থী শাহ মঞ্জুরুল হক। পরে পুলিশের মাধ্যমে তাদের সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ভোট গণনার সময় সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে হলরুমে ঢুকে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন যুবলীগের অনেক নেতাকর্মী।

Vote2

এ ঘটনায় সরকার দলীয় একজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলকে মারধর করা হয়। পরে তিনি নাহিদ সুলতানা যুথীকে প্রধান আসামি করে একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। এ মামলায় অ্যাডভোকেট যুথী প্রধান আসামি। বাকি আসামিরা হলেন- অ্যাডভোকেট মো. জাকির হোসেন ওরফে মাসুদ, অ্যাডভোকেট শাকিলা রওশন, অ্যাডভোকেট কাজী বশির আহম্মেদ, ব্যারিস্টার উসমান, অ্যাডভোকেট আরিফ, অ্যাডভোকেট সুমন, অ্যাডভোকেট তুষার, রবিউল, ব্যারিস্টার চৌধুরী মৌসুমী ফাতেমা (কবিতা), সাইদুর রহমান জুয়েল, অলিউর, যুবলীগ নেতা জয়দেব নন্দী, মাইন উদ্দিন রানা, মশিউর রহমান সুমন, কামাল হোসেন, আসলাম রাইয়ান, অ্যাডভোকেট তরিকুল ও অ্যাডভোকেট সোহাগ। এছাড়া মামলায় ৩০/৪০ জন অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।

এদিকে সুপ্রিম কোর্টের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ।  তিনি বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ জননেত্রী শেখ হাসিনার ভ্যানগার্ড। একটা অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যেই যুবলীগের আইনজীবীরা সমবেত হয়ে গত ৬ ও ৭ মার্চ উৎসবমুখর পরিবেশে সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনে ভোট দিয়েছে। গত ৮ মার্চ উক্ত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। উক্ত ঘটনা বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কোনোভাবেই সমর্থন করে না। বিচ্ছিন্নভাবে সংগঠনের কেউ যদি উক্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে তা নিরপেক্ষ তদন্তপূর্বক সাংগঠনিক ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে। একইসাথে সার্বিক অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা তৈরি হওয়ার জন্য আমরা সকলেই দুঃখ প্রকাশ করছি।

আরও পড়ুন

আইনজীবী যুথি-কাজলসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা

এই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয়েছে বিএনপি প্যানেল থেকে সম্পাদক পদে নির্বাচন করা ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলকেও। ইতোমধ্যে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে এবং রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

‘ভোটটা আইনজীবীদের মধ্যেই রাখতে হবে’

এমন বাস্তবতায় সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন সুষ্ঠু করতে দলীয় রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ। হিউম্যান রাইডস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এক সময় সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন এরকম ছিল না। তখন আইনজীবীদের মধ্যে পেশাদারিত্ব বিবেচনা করে ভোট হতো। আর এখন দলনির্ভর হয়ে গেছে। দলীয় বিবেচনায় মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। দলের অধীনে নির্বাচন করতে দলীয় প্রধানের কাছে ধরনা দিতে হচ্ছে। দল যাকে মনোনয়ন দিচ্ছে সে নির্বাচন করছে। অনেক সময় ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার জন্য দলীয় প্রভাব খাটানো হচ্ছে। এসব কালচার থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে। ভোটটা আইনজীবীদের মধ্যেই রাখতে হবে। দলীয় কর্তা ব্যক্তিরা এটা নির্ধারণ করে দিলে সুপ্রিম কোর্ট বারের ভোট নিয়ে সমস্যা বাড়তেই থাকবে। এজন্য আইনজীবীদের উচিত দলীয় ব্যানার থেকে বের হয়ে এসে নির্বাচন করা উচিত।’   

Vote3

সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সহসভাপতি আব্দুল জাব্বার ভুঁইয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘তিন বছর আগেও সুপ্রিম কোর্ট বারের ইলেকশন ফেয়ার ছিল। নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হতো। এখন সেটা হচ্ছে না। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব খাটিয়ে কারচুপি করে ব্যালট জাল করে তাদের পক্ষে ফলাফল নিয়ে নিচ্ছে। তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে পনের বছর যাবত। এর আগে গত দুই বছর নির্বাচনে ফলাফল ছিনিয়ে নিয়েছে। জাল ভোট দিয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছিলাম সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠানের। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এটা করতে দিচ্ছে না।’

এদিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ফলাফল বাতিল, ফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে মারামারির ঘটনা একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হাইকোর্টে আবেদন করা হয়েছে। আবেদনে বার নির্বাচনের ফল ঘোষণার দিন আইনজীবী এস আর সিদ্দিকীকে মারধরের ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ দেখে বহিরাগতসহ অভিযুক্তদের গ্রেফতার, এ ঘটনায় গ্রেফতার আইনজীবীদের রিমান্ড স্থগিত এবং যেকোনো মামলায় আইনজীবীদের গ্রেফতার করা হলে তাদের রিমান্ডে না নেওয়ার আর্জি জানানো হয়।

আরও পড়ুন

সভাপতিসহ ৪ পদে বিএনপি, সম্পাদকসহ ১০ পদে আ.লীগ জয়ী

সমিতির নির্বাচন নিয়ে ২০১২ এবং ২০১৩ সালে করা দুটি রিটের সঙ্গে গত বুধবার (১৩ মার্চ) সম্পূরক একটি আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনে সভাপতি প্রার্থী ইউনুছ আলী আকন্দ। ২০১২ সালে বার নির্বাচনের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্যানেলভিত্তিক নির্বাচন নিয়ে তখনকার সভাপতি প্রার্থী হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। ওই রিটের শুনানি নিয়ে আদালত রুল জারি করেন।

এছাড়া ২০১৩ সালের বার নির্বাচনের পর আরেকটি রিট করেন ইউনুছ আলী আকন্দ। ওই রিটের শুনানি নিয়ে আদালত রুল জারি করেছিলেন। ওই দুই রিটের রুল শুনানির অপেক্ষায় আছে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২৪-২৫ সেশনের নির্বাচনে সভাপতি পদে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ চারটি পদে বিএনপি সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা বিজয়ী হন। অন্যদিকে সম্পাদক পদে শাহ মঞ্জুরুল হকসহ ১০টি পদে আওয়ামী লীগের প্যানেলের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।

গত শনিবার (৯ মার্চ) দিবাগত রাত দেড়টার দিকে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবুল খায়ের এ ফল ঘোষণা করেন।

এআইএম/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর