‘পুরাতন সামরিক যানগুলো বিশাল মোবাইল বোমায় পরিণত করে আবাসিক এলাকার কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করা হয় এবং রিমোটের মাধ্যমে এগুলোর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভবনগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়। ফলে আশেপাশের যেকোনও ব্যক্তি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে টুকরো টুকরো হয়ে যায়- এর প্রভাব বিমান হামলার চেয়েও ভয়াবহ এবং ধ্বংসাত্মক।’
ইসরায়েলের এই মারণাস্ত্র সম্পর্কে বলছিলেন গাজার বাসিন্দা আলম আল-ঘৌল, স্থানীয়রা এটিকে ‘বুবি-ট্র্যাপ রোবট’ বলে বর্ণনা করে থাকেন। তারা বলছে, এই প্রথমবারের মতো এমন অস্ত্র দেখছে তারা, যা অতীতে কোনও যুদ্ধ পরিস্থিতিতেই তারা দেখেনি, খুব ঘন ঘন এগুলো ব্যবহার করে গাজায় আক্রমণ হচ্ছে এখন।
বিজ্ঞাপন
আল-ঘৌল বলেন, ‘এই রোবটগুলো পুরানো ট্যাঙ্ক বা সৈন্যবহনকারী সাঁজোয়া হতে পারে, যা আর ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত নয়। তারা (ইসরায়েল) এগুলো বিস্ফোরক দিয়ে ভরে দেয় এবং তারপর গাজা শহরের রাস্তায় ফেলে যায় এবং রিমোটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে। লক্ষ্যবস্তু এলাকায় স্থাপনের কয়েক মিনিট পরেই একটি বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে। তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আকাশ রক্তবর্ণ হয়ে যায়।’
মাঝে মাঝে গাজায় যুদ্ধে নিহতদের মৃরদেহ উদ্ধারে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা আল-ঘৌল আরও বলেন, ‘বিস্ফোরণ এলাকার আশেপাশে যদি মানুষ থাকে, তাহলে তাদের কোনও চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি ধ্বংসাবশেষও ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, আমরা তাদের অক্ষত পাই না।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, গত ১৩ আগস্ট থেকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা শহরের অভ্যন্তরে স্থল অভিযান চালিয়ে আসছে, যাতে শুধুমাত্র এই সময়ে ১১০০ মানুষ নিহত এবং ৬ হাজারেরও বেশি আহত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে গাজা উপত্যকার স্বাস্থ্য ও সরকারি কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যানে।
বিজ্ঞাপন
বিবৃতি অনুসারে, সামরিক অভিযানে ৭০ টিরও বেশি সরাসরি বিমান হামলার পাশাপাশি যুদ্ধবিমান দিয়ে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে, জনবহুল এলাকায় ১০০ টিরও বেশি বিস্ফোরক রোবট বিস্ফোরণের ফলে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে।
ইসরায়েলি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, এটি এতটাই শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে যে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে তেল আবিবেও তা অনুভূত হতে পারে।
বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর এই অস্ত্র মোতায়েনের অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল আভিচায় আদরাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিবিসি অ্যারাবিক।
তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা অপারেশনাল পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করি না, তবে আমি বলতে পারি যে আমরা এক্ষেত্রে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করি - কিছু অত্যন্ত উদ্ভাবনী এবং প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত – এসব আমাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য, হামাস সন্ত্রাসীদের নির্মূল করতে এবং ইসরায়েলি সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে।’
ভয়াবহ বিস্ফোরণ
গাজা শহরের আরেক বাসিন্দা নিদাল ফাওজি প্রশ্ন তোলেন, গাজা কি ইসরায়েলি অস্ত্রের সক্ষমতা পরীক্ষার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে কি না। তিনি বলেন, তথাকথিত রোবটগুলো ‘বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয় এবং মানুষকে পালাতে বাধ্য করে।’
পূর্ববর্তী একটি সামরিক অভিযানের সময়ও এই অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন মধ্যরাত ছিল। আমি একটি সামরিক যানকে বিশাল, আয়তাকার ‘রোবট’ টেনে নিয়ে যেতে দেখেছি। তারা এটিকে একটি দেয়ালের সঙ্গে আটকে রেখে চলে যায়। আমি আমার পরিবারকে চিৎকার করে বলি, অবিলম্বে সেখান থেকে চলে যেতে হবে। আমরা পালিয়ে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরেই, এমন একটি বিস্ফোরণ ঘটে যা আমি আগে কখনও দেখিনি।’
বিস্ফোরণের ভয়াবহতা উল্লেখ করে ফাওজি আরও বলেন, ‘আল-জায়তুনে, আমি মৃরদেহগুলোকে ছোট ছোট টুকরো হতে দেখেছি। এমনকি ১০০ মিটার দূরেও, বিস্ফোরণের চাপে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মানুষ মারা গেছে। এই যুদ্ধে আমরা যা দেখেছি, তার মধ্যে এটিই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র।’
তিনি জানান, বিস্ফোরণের আগে সেখানকার বাসিন্দারা কেবল পালানোর কথাই ভাবছিলেন, তারা ‘বিস্ফোরক লৌহ দানব’ থেকে পালানোর চেষ্টা করছিলেন।
সামরিক অভিযানের খরচ কমানো
কাতারের জোয়ান বিন জসিম একাডেমি ফর ডিফেন্স স্টাডিজের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হানি আল-বাসৌস, যিনি পূর্বে গাজা উপত্যকায় কাজ করেছিলেন, তিনি বলেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সামরিক অভিযানের খরচ কমাতে এবং ইসরায়েলি হতাহত এড়াতে সরাসরি সংঘর্ষ ছাড়াই আবাসিক এলাকা, টানেল ও বড় ভবন ধ্বংস করতে এই দূরবর্তী নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরক যানবাহন ব্যবহার করছে।
তিনি আরও জানান, এগুলো প্রচুর পরিমাণে বিস্ফোরক বহন করে এবং তা টানেল ও আবাসিক ব্লকে ব্যবহার করা হয়, যার ফলে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে।
গাজার আরেক বাসিন্দা কারেম আল-ঘারাবলি বলেন, তিনি ২০২৫ সালের এপ্রিলে গাজা শহরের পূর্বে একটি বহুতল আবাসিক ভবনে ইসরায়েলি হামলার সময় এই অস্ত্রের ব্যবহার দেখেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি বিস্ফোরণ থেকে প্রায় ৪০০ মিটার দূরে ছিলাম, তবুও বিস্ফোরকের টুকরো এবং পাথর আমাদের বাড়িতে পৌঁছে যায়। আকাশ লাল হয়ে যায় এবং সেই আলোতে প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। ব্যাপারটা খুবই ভয়ঙ্কর ছিল।’
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ড. মুনির আল-বুরশ বলেছেন, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এখন গাজা শহরের অভ্যন্তরে প্রতিদিনই এই ‘বিস্ফোরক রোবট’-এর ওপর নির্ভর করছে। এটি একটি কৌশল, যা বেসামরিক নাগরিকদের জন্য সরাসরি হুমকি সৃষ্টি করে মানবিক বিপর্যয়কে আরও খারাপ করে তুলছে।’
তিনি আরও দাবি করেন, প্রতিটি রোবট সাত টন পর্যন্ত বিস্ফোরক বহন করতে পারে, যেগুলোর মধ্যে প্রতিদিন সাত থেকে দশটি বিস্ফোরিত হয়, যা ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ঘটাচ্ছে এবং পশ্চিম গাজার জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৬০ হাজারে উন্নীত করছে।
ড. মুনির আল-বুরশ সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এই রোবটগুলোর ক্রমাগত ব্যবহার ‘গণহত্যা সংঘটন এবং আবাসন অবকাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস’ করতে পারে, বিশেষ করে অবরোধের সময় উদ্ধার ও ত্রাণ সক্ষমতার ঘাটতি তৈরির মাধ্যমে। বিবিসি বাংলা
এমএইচআর

