মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সৌদি আর পাকিস্তানের সঙ্গে তুরস্কও কি যোগ দিচ্ছে!

এমএম সালাহউদ্দিন
প্রকাশিত: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:৪৬ পিএম

শেয়ার করুন:

সৌদি আর পাকিস্তানের সঙ্গে তুরস্তও কি যোগ দিচ্ছে !

ইসরায়েলের লাগামহীন সামরিক আগ্রাসনে চরম অস্থিরতা তৈরি হয়েছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে। সম্প্রতি কাতারে হামলার পর এ অঞ্চলে দখলদার দেশটির আরব মিত্ররাও এখন নড়েচড়ে বসছে। 

নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে এক ঐতিহাসিক ও কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে পাকিস্তান ও সৌদি আরব। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উপস্থিতিতে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। 


বিজ্ঞাপন


‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’ নামে পরিচিত এই সমঝোতাকে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

চুক্তি স্বাক্ষরের সময় প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে সৌদি রাজপরিবারের পক্ষ থেকে পূর্ণ রাজকীয় প্রটোকল দেওয়া হয়। রিয়াদে পৌঁছানোর পর তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং আকাশে সৌদি এফ-১৫ যুদ্ধবিমান দিয়ে সালাম জানানো হয়। 

রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়— আল-ইয়ামামাহ প্রাসাদে, যেখানে সৌদি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।


বিজ্ঞাপন


কাতারে সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা ও আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে এবার নতুন করে তুরস্ককে নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আঙ্কারার এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, ইসরায়েলের পরবর্তী নিশানা কি তুরস্ক?

যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং ‘মেজর নন-ন্যাটো অ্যালাই’ হিসেবে স্বীকৃত কাতারে যেভাবে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল, এতে মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন মিত্র দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে।

ইসরায়েলপন্থী বিভিন্ন মহল এখন তুরস্ককে সামনে রেখে মন্তব্য করা শুরু করেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো মাইকেল রুবিন সরাসরি সতর্ক করে বলেন, ইসরায়েলের পরবর্তী টার্গেট হতে পারে তুরস্ক। এ ক্ষেত্রে ন্যাটো সদস্যপদকে নিরাপত্তার ঢাল হিসেবে ভাবা উচিত হবে না।

ইসরায়েলি রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেয়ির মাসরি সামাজিকমাধ্যমে লিখেছেন, ‘আজ কাতার, কাল তুরস্ক’— এই বক্তব্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং আঙ্কারায় কড়া প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। 

প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ানের এক শীর্ষ উপদেষ্টা টুইট করে বলেন, জায়নবাদী ইসরায়েল একটি ভয়ঙ্কর প্রাণী, যার দ্রুত মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়া দরকার, তখনই বিশ্বে শান্তি ফিরবে।

গত কয়েক মাস ধরেই ইসরায়েলপন্থী বিভিন্ন গণমাধ্যম তুরস্ককে ইসরায়েলের ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের কৌশলগত উপস্থিতি এবং যুদ্ধ-পরবর্তী সিরিয়ায় দেশটির সক্রিয় ভূমিকাকে ইসরায়েলি বিশ্লেষকরা হুমকি হিসেবে তুলে ধরছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগস্ট মাসে গাজায় চলমান গণহত্যার প্রতিবাদে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান ঘোষণা দেন, তুরস্ক ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করছে। 

আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইসরায়েলের আগ্রাসনের কোনো সীমা নেই এবং যুক্তরাষ্ট্র এর পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

এ অবস্থায় অনেকে ভাবছেন, নিজ দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবার হয়তো পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সঙ্গে সামরিক জোটে তুরস্কও যোগ দেবে।

তবে, এই ভাবনা আমূলক নয়- এর আগেও এই অঞ্চলে অস্থিরতা বন্ধে এবং ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের গণহত্যা রোধে ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর সেনাদের নিয়ে ন্যাটোর আদলে সামরিক জোট গঠনের ডাক দিয়েছিলেন এরদোগান।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে গাজায় গণহত্যার পাশাপাশি ইসরায়েল নিয়মিত হামলা চালাচ্ছে ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীর, ইয়েমেন, সিরিয়া এমনকি তিউনিসিয়াতেও। গাজার জন্য ত্রাণ নিয়ে যাওয়া বহরেও হামলার ঘটনা ঘটেছে।

তুরস্কের অবসরপ্রাপ্ত নৌবাহিনী কর্মকর্তা অ্যাডমিরাল সেম গুরদেনিজ মনে করেন, ইসরায়েল-তুরস্ক সামরিক সংঘাত শুরু হলে সেটি ঘটবে সিরিয়ার আকাশ ও স্থলভূমিতে। 

তিনি বলেন, সাইপ্রাসে ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতিকে আঙ্কারা একটি ‘ঘেরাও কৌশল’ হিসেবে দেখছে, যা তুর্কি সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও সাইপ্রাসে বসবাসকারী তুর্কিদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সিরিয়ার ভবিষ্যত নিয়েও ইসরায়েল ও তুরস্কের অবস্থান পুরোপুরি ভিন্ন। ইসরায়েল চাইছে, সিরিয়া একটি ফেডারেল কাঠামোতে বিভক্ত হোক, যেখানে অঞ্চলভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন থাকবে। 

বিপরীতে তুরস্ক সমর্থন করছে একটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র কাঠামো। সেটার গবেষণা পরিচালক মুরাত ইয়েসিলতাস বলেন, সিরিয়া নিয়ে তুরস্কের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট এবং এটি একটি লাল রেখা। তিনি সতর্ক করেন, যদি ইসরায়েল এই পথে এগোয়, তাহলে আঙ্কারা-তেলআবিব সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে।

তবে, পূর্ণাঙ্গ সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা নিয়ে সবাই একমত নন। কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক আন্দ্রেয়াস ক্রিগ মনে করেন, ইসরায়েল সরাসরি তুরস্কের বিরুদ্ধে বড় ধরনের হামলায় যাবে না। বরং ইসরায়েল এমন কৌশল অবলম্বন করবে, যা গোপন থাকে— যেমন গোপন অভিযান, প্রক্সি যুদ্ধ, কিংবা সীমিত বিমান হামলা। 

তার মতে, ইসরায়েল এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে পূর্ব ভূমধ্যসাগর, সিরিয়া ও দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে তুরস্কের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে।

অধ্যাপক ক্রিগ পরামর্শ দেন, এই পরিস্থিতিতে তুরস্কের উচিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, কাতার, জর্ডান ও ইরাকের সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সংলাপ চালিয়ে যাওয়া, যাতে ভবিষ্যতে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে আঙ্কারা।

অন্যদিকে, পাকিস্তানের সৌদি আরবের সঙ্গে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা চুক্তিতে উপনীত হওয়া কেবল প্রতিরক্ষা বা সামরিক প্রস্তুতির বিষয় নয়, বরং এটি এক ধরনের কূটনৈতিক অবস্থান পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা হচ্ছে। 

চুক্তির ফলে দুই দেশের মধ্যে যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র উৎপাদনে সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগ এবং সেনা মোতায়েনের মতো বিষয়গুলোতে সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।

ইতোমধ্যেই পাকিস্তান ৮ হাজারের বেশি সৌদি সেনাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং অতীতে বিভিন্ন সময়ে সৌদি আরবে পাকিস্তানি সেনা মোতায়েন ছিল।

চুক্তির বাস্তবায়ন হলে পাকিস্তানের সামরিক উপস্থিতি সৌদি আরব ও উপসাগরীয় অঞ্চলে আরও বাড়তে পারে। এতে উপসাগরীয় নিরাপত্তা কাঠামোয় পাকিস্তান একটি কার্যকর অংশীদার হয়ে উঠবে। 

বিশেষ করে, উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (GCC) সদস্য দেশগুলো ইতোমধ্যে যৌথ প্রতিরক্ষা উদ্যোগের কথা বলেছে। ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক নীতির প্রেক্ষাপটে এসব দেশ নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করতে চাইছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রতিরক্ষা চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হবে। কারণ, পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অতীতে একাধিকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে একাধিক নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। ফলে পাকিস্তান-সৌদি ঘনিষ্ঠতা যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক কৌশলে নতুন প্রশ্ন তুলতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই চুক্তি মূলত রাজনৈতিক বার্তা বহন করে, যেখানে পাকিস্তান নিজের আঞ্চলিক গুরুত্ব আবারও প্রমাণ করতে চায়। পাশাপাশি, সৌদি আরবও স্পষ্ট করছে যে, শুধু পশ্চিমা জোটের ওপর নির্ভর করে তারা চলতে চায় না। বরং মুসলিম বিশ্বের মধ্যেই সামরিক ও কৌশলগত বিকল্প জোট গড়ার পথ অনুসন্ধান করছে।

এর সঙ্গে তুরস্ক যুক্ত হলে এতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। কারণ সামরিক শক্তিতে তুরস্কও কম যায় না। ন্যাটোর একটি অন্যতম শক্তিশালী সদস্য হচ্ছে তুরস্ক। সময়ই বলে দেবে, তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যের এ জোটে যোগ দেকে কি-না?

-এমএমএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর