শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

চীন-রাশিয়ার ছায়ায় মোদি, কূটনীতির পালা ঘুরছে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:০৯ এএম

শেয়ার করুন:

চীন-রাশিয়ার ছায়ায় মোদী, কূটনীতির পালা ঘুরছে?
চীন-রাশিয়ার ছায়ায় মোদী, কূটনীতির পালা ঘুরছে?

চীনের তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলন শেষে দিল্লি ফিরেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই সফরে তিনি শুধু সম্মেলনে অংশই নেননি, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলাদা বৈঠকেও বসেছেন।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক টানাপোড়েনের পরিপ্রেক্ষিতে, মোদির এই চীন সফর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা বহন করেছে বলেই মনে করছে কূটনৈতিক মহল।


বিজ্ঞাপন


মোদির এই সফরের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে, ভারত শুধু পশ্চিমা মিত্রদের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং বহুমুখী কূটনীতির পথে এগোচ্ছে। বিশেষ করে, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ভারসাম্য রক্ষা করতেই মোদি সক্রিয় হয়েছেন বলে বিশ্লেষকদের মত।

সফরের শুরুতেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বসেন মোদি। সেখানে তিনি বলেন, বিশ্বের প্রাচীনতম দুটি সভ্যতা ও সর্বাধিক জনসংখ্যার দুই দেশ—ভারত ও চীন একসঙ্গে কাজ করলে তা শুধু দুই দেশের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ বয়ে আনতে পারে।

শি জিনপিংও ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার বার্তা দিয়ে বলেন, বর্তমান বিশ্ব এক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং এই পরিবর্তনের সময় চীনের ড্রাগন ও ভারতের হাতি একসঙ্গে এগোলে সেটিই সময়ের দাবি। তিনি এটিও উল্লেখ করেন, চীন ও ভারত প্রতিপক্ষ নয়, বরং সহযোগিতার অংশীদার হতে পারে।

দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা সরাসরি বিমান পরিষেবা আবার চালু হওয়ার বিষয়েও ওই বৈঠকে আলোচনা হয়। মোদি জানান, ভারত ও চীনের মধ্যে ফ্লাইট শিগগিরই চালু হতে চলেছে।


বিজ্ঞাপন


এরপর এসসিও সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নেন মোদি। তবে এর আগে এক বিরল আন্তরিকতায় দেখা যায় মোদি, শি ও পুতিন—তিনজন বিশ্বনেতা একসঙ্গে হাস্যরস, আলিঙ্গন ও করমর্দনের মাধ্যমে সৌহার্দ্যের বার্তা দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন

মার্কিন পণ্যের শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছে ভারত, দাবি ট্রাম্পের

সম্মেলনের পরে প্রধানমন্ত্রী মোদি এক্স হ্যান্ডেলে লিখেন, তিয়ানজিনে কথোপকথন অব্যাহত। প্রেসিডেন্ট শি ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে মতবিনিময় খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। আরেকটি পোস্টে তিনি লিখেন, প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে দেখা হওয়া সবসময়ই আনন্দের।

সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর পুতিনের সঙ্গে এক গাড়িতে চড়ে রিটজ কার্লটন হোটেলের উদ্দেশে রওনা দেন মোদি। প্রায় এক ঘণ্টার এই যাত্রায় দুই নেতার মধ্যে হয় একান্ত আলোচনা। রুশ সংবাদমাধ্যম জানায়, এই আলোচনা ছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত এবং অত্যন্ত সংবেদনশীল।

পরে দু’দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারত্ব জোরদার করা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়। মোদি বলেন, যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে গঠনমূলক পথে এগোতে হবে। একইসঙ্গে তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ডিসেম্বর মাসে ভারতে অনুষ্ঠিতব্য ২৩তম ভারত-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানান।

পুতিনের সফরের বিষয়টি রাশিয়ার পক্ষ থেকে আগেই নিশ্চিত করা হয়েছিল। মোদি বলেন, ১৪০ কোটির ভারত আপনার অপেক্ষায় রয়েছে।

তবে সম্মেলনের আরেকটি দিক ছিল, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের উপস্থিতি, যাকে একরকম কৌশলে উপেক্ষা করেই চলেছেন মোদি। একপর্যায়ে দেখা যায়, মোদি ও পুতিন করমর্দন ও হাস্যরসে মেতে রয়েছেন, সেখানে শরিফ পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাননি।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনা এবং সীমান্ত সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে এই দৃশ্য অনেকটাই প্রতীকী বার্তা বহন করে বলে মত কূটনৈতিকদের।

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মোদির অবস্থান ছিল সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদ কোনো এক দেশের সমস্যা নয়, এটি গোটা মানবতার বিরুদ্ধে হুমকি। দ্বিচারিতা বরদাশত করা হবে না। যারা প্রকাশ্যে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে, তাদের বিরুদ্ধেও একযোগে রুখে দাঁড়াতে হবে।

যদিও তিনি কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেননি, তবে এসসিও’র যৌথ ঘোষণায় পহেলগামে হওয়া সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানানো হয় এবং হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানানো হয়। ভারত এই ঘোষণাকে একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখছে।

চীনের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি মোদি পরোক্ষভাবে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (BRI) নিয়েও আপত্তির সুর তোলেন। এই প্রকল্পটি পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে যাওয়ায়, ভারত শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছে।

মোদি বলেন, সংযোগ তখনই অর্থবহ, যখন তা কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। অন্যথায় সেটা আস্থাহীন হয়ে পড়ে।

এই বক্তব্যে তিনি চীনের প্রকল্পের বিরুদ্ধেই পরোক্ষ বার্তা দিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি তিনি জানান, ভারত ইরানের চাবাহার বন্দর ও উত্তর-দক্ষিণ করিডরের মাধ্যমে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে একটি টেকসই সংযোগ গড়ে তুলতে চায়।

এই প্রকল্পে ভারত যেমন বড় বিনিয়োগ করছে, তেমনি একে তারা চীনের বিআরআইয়ের বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতে চায়, যেখানে আঞ্চলিক শ্রদ্ধা ও সার্বভৌমত্বকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

সব মিলিয়ে এই এসসিও সম্মেলনে মোদির সক্রিয় উপস্থিতি, শি ও পুতিনের সঙ্গে দৃঢ় বৈঠক এবং পাকিস্তান ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী স্পষ্ট বার্তা—সবকিছু মিলিয়ে এই সফর ছিল ভারতের জন্য একটি কৌশলগত ও কূটনৈতিক সাফল্যের মঞ্চ।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিছুটা টানাপোড়েন চললেও, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে ভারত দেখাতে চাইছে; তারা একক কোনো বলয়ের অংশ নয়, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থানকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও বহুমুখী করে তুলতেই আগ্রহী। সূত্র: বিবিসি

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর