গত কয়েক মাস ধরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে ‘দর কষাকষি’ চলছিল। এরইমধ্যে ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পাশাপাশি রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র কিনলে ভারতের ওপর বাড়তি জরিমানার কথাও বলেছেন।
এর আগে, গত এপ্রিলে ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৬ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তা কার্যকরের সময়সীমা পিছিয়ে পহেলা আগস্ট করেছিলেন। তার আগেই আবারও শুল্কহার ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। তবে বিষয়টা এখানেই থেমে থাকেনি।
বিজ্ঞাপন
ভারতের বাণিজ্য নীতির সমালোচনার পাশাপাশি একাধিক মন্তব্যে রাশিয়া ও পাকিস্তানের প্রসঙ্গ টেনে এনে ভারতকে কটাক্ষও করতে ছাড়েননি ট্রাম্প। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য শুল্কের বিষয়ে ঘোষণার পর পাকিস্তানের সঙ্গে অয়েল রিজার্ভ নিয়ে চুক্তির ঘোষণা করেন তিনি।
সেই ঘোষণার সময় ভারতকে ‘খোঁচা’ দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা নতুন চুক্তি করেছি। এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান যৌথভাবে বিশাল তেলের মজুদ গড়ে তুলবে। কোন তেল সংস্থা এই অংশীদারিত্বের নেতৃত্ব দেবে, সেটা আমরা ঠিক করব। কে জানে, হয়তো একদিন পাকিস্তান ভারতের কাছে তেল বিক্রি করবে।’
বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি এখনো হয়নি। তবে বাণিজ্য চুক্তির অগ্রগতি নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে খুশি নন তা হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
এই আবহে প্রশ্ন উঠেছে–– মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণা ভারতে কী প্রভাব ফেলতে পারে? বাণিজ্যের দিক থেকে ভারতের কাছে এখন বিকল্প কোন রাস্তা খোলা আছে?
পরিস্থিতি কতটা ‘জটিল’?
বর্তমান পরিস্থিতিতে যে 'জটিলতা' তৈরি হয়েছে সেটা মেনে নিয়েছেন বিশ্লেষকরা। একদিকে, ভারত ইতোমধ্যে অভিবাসন ইস্যু, মার্কিন আমদানিতে শুল্কসহ একাধিক ক্ষেত্রে ছাড়ের কথা জানিয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার পাশ থেকে সরে আসা ভারতের পক্ষে কঠিন বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো রাখতে চায় ভারত। পাশাপাশি ব্রিকসও যে একটা বড় বিষয়, সেটা ইতোমধ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এই সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খুব একটা সহজ নয়।
ওয়াশিংটনে অবস্থিত উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং বিদেশ নীতি বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত এখনো একটা চুক্তিতে পৌঁছাতে পারে। এখনো পহেলা আগস্ট হয়নি। তার পরেও একটা চুক্তি হওয়া সম্ভব। কিন্তু ভারত ইতোমধ্যেই (শুল্কের ক্ষেত্রে, বৃহত্তর বাণিজ্য এবং অভিবাসন ইস্যুতে) ছাড় দিয়েছে এবং এটা কল্পনা করা কঠিন যে রাজনৈতিকভাবে আরও কিছু করার সামর্থ্য তাদের রয়েছে।’
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৯০ বিলিয়ন ডলার। তারপরও ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, যা কমিয়ে আনতে চান ট্রাম্প।
কী প্রভাব পড়তে পারে?
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষক উপমন্যু বসু বলেছেন, ‘এই বাণিজ্য শুল্কের ঘোষণা খুব শকিং বলব না। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের একটা বড় ইস্যু হলো তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে নন-ডিপ্লোমেটিক পদ্ধতিতে ডিল করছে এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সম্পর্কে ভাবনা চিন্তা করছে না।’
তিনি বলেন, ‘ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে দর কষাকষি আগেও হয়েছে। কিন্তু যেভাবে বিষয়টাকে ট্রাম্প ডিল করেছেন, সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট শেয়ার করেছেন, জরিমানা ঘোষণা করেছেন-তাতে একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব দেখা যেতে পারে। যদিও এখনো দুই দেশের মধ্যে এই নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলবে, কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে দুই দেশের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে।’
বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণাকে এখনই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছেন না 'জিন্দল স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স'-এর অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর ড. গীতাঞ্জলি সিনহা রায়।
তার মতে, "ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। গতকাল দুই দেশ মিলে স্যাটেলাইট লঞ্চ করেছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে বলতে গেলে রাজনৈতিক, আর্থিক, প্রতিরক্ষা এবং সামাজিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য। বাণিজ্য অবশ্য দুই দেশের সম্পর্কের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাণিজ্যে কিছু হলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে।"
রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক
ভারত যে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইবে না, সে কথা মেনে নিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রফেসর উপমন্যু বসু বলেছেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেনের বিষয়ে ভারত প্রথম থেকে একটাই অবস্থান বজায় রেখেছে। ভারত যে যুদ্ধের পক্ষে নয়, তা স্পষ্ট করেছে। সেটা রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে প্রভাবিত করেনি। বিশ্বজুড়ে রাশিয়া যে ডিপ্লোম্যাটিক ক্রাইসিসে পড়েছিল সেই সময় ভারত সাহায্য করেছে। কিন্তু সমস্যা হলো যুক্তরাষ্ট্রের 'হয় আমরা, নয় ওরা'- এই নীতি। তারা এখনো মনে করে এটা ইউনিপোলার ওয়ার্ল্ড। তারাই সর্বেসর্বা! যেটা তাদের বিদেশ নীতি এবং ট্রাম্পের বলার ধরন দেখে বুঝতে অসুবিসধা হয় না।’
তিনি মনে করেন ট্রাম্প প্রশাসনের এই নীতি ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশকেই প্রভাবিত করবে।
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এই মনোভাব থাকলে চীনের জন্য বিষয়টা আরও সহজ হয়ে দাঁড়াবে, যার একটা ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও জটিলতা বাড়াবে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থিরতা প্রভাবিত হবে। এই চিন্তা-ভাবনা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আরও জটিল করে তোলে, বিশেষত একটা পক্ষ যখন নিগোশিয়েশনের জন্য রাজি হয় না। এখন দিল্লি কীভাবে এই বিষয়টা নিয়ে এগোয় সেটা দেখার।’
ভারতের কাছে কী পথ খোলা আছে
বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য ভারতের কাছে একাধিক পথ খোলা আছে বলে মনে করেন উপমন্যু বসু। তার কথায়, ‘সম্ভাব্য একটা পথ হলো ট্রাম্পের সঙ্গে আবার নেগোশিয়েশনে গিয়ে ওই শুল্ক কমানো। আলাপ-আলোচনা অবশ্যই হবে, কিন্তু কতটা কমবে সেটা দেখার।’
‘দ্বিতীয় পথ হলো অন্য বিকল্প খোঁজা। জাপান ও ফ্রান্সের সঙ্গে তো বাণিজ্যিক দিক থেকে সম্পর্ক ভালো ছিল, এখন যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও ভারতের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো। সেটাও কাজে লাগাতে চেষ্টা করবে ভারত।’
অন্য বিকল্পের কথা বলেছেন ড. সিনহা রায়ও। তার মতে, ‘সম্ভাব্য পথের মধ্যে একটা হতে পারে যে ডেফিসিটটা (ঘাটতি) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হবে সেটাকে অন্য দেশে পরিচালিত করা। ‘বিদেশ নীতির দিক থেকে আমি মনে করি ভারতের বাণিজ্যের জন্য অন্য দেশের প্রতি এতটা নির্ভরশীল হওয়ার দরকার নেই, অভ্যন্তরীণ দিক থেকে একটা ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘যেমন কোভিডের সময় অনেক সংস্থা চীন থেকে ফ্যাক্টরি সরিয়ে নিয়েছিল, সে দেশ থেকে আমদানি কমানোর কথা বলেছিল। কিন্তু চীনের উৎপাদন ক্ষমতা এত বেশি যে চাইলেও তাদের এড়ানো সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ জাপানও বলেছিল চীনের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না, কিন্তু তেমনটা বাস্তবে হয়নি। ভারতেরও চীনের মতো নিজেদের উৎপাদন হাব হিসেবে তুলে ধরা উচিত। তার জন্য ম্যানুফ্যাকচারিং এবং প্রোডাকশন সেক্টরের ওপর জোর দিতে হবে।’
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এমএইচআর

