ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গত কয়েক বছর ধরে পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গত মাসে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর এই ধরনের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।
১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের ভূখণ্ডে বিনা উসকানিতে হামলা চালায়। এর লক্ষ্য ছিল দেশটির উচ্চপদস্থ সামরিক কমান্ডার, পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং বেসামরিক নাগরিক লোকজন। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে ইসরাইলের সঙ্গে যোগ দেয়। হামলা চালায় ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা। এসব হামলাকে ব্যাপকভাবে জাতিসংঘের সনদ এবং অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
আগ্রাসনের জবাবে দ্রুত এবং শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া জানায় ইরান। দেশটির সশস্ত্র বাহিনী তেল আবিব এবং হাইফার মতো শহরে কৌশলগত ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায় এবং পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তম আমেরিকান সামরিক স্থাপনা কাতারের আল-উদেইদ বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালায়।
২৪ জুনের মধ্যে ইরানের সমন্বিত অভিযান কার্যকরভাবে ইসরায়েলি ও আমেরিকান আগ্রাসন বন্ধ করে দেয়। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির মাত্রা এবং নির্ভুলতা ইসরায়েল এবং তার পশ্চিমা মিত্রদের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হতবাক করে দেয়।
১২ দিনের যুদ্ধের বিষয়ে অবগত রয়েছেন এমন মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল শুক্রবার বলেছে, ‘‘ইসরায়েলের অ্যারো, ডেভিডস স্লিং এবং আয়রন ডোমের মতো নিজস্ব অত্যাধুনিক বহুস্তরীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকা সত্বেও দেশটি নিজস্ব ইন্টারসেপ্টরের (প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র) অভাব বোধ করে এবং সংঘাত শেষ হওয়ার সময় এই ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ শুরু করে। ইরান আরও কয়েকটি বড় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করলে ইসরায়েলের উচ্চ-স্তরের অ্যারো-৩ যুদ্ধাস্ত্রের সরবরাহ শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।’’
জার্নালটি আরও প্রকাশ করেছে, সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলে দুটি উন্নত থাড ক্ষেপণাস্ত্র-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করা সত্ত্বেও, মার্কিন প্রচেষ্টা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
‘‘ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করার পাশাপাশি থাড অপারেটররা দ্রুত প্রতিরক্সা ক্ষেপণাস্ত্রটির মজুদ শেষ করে ফেলে। ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের তরঙ্গকে ধ্বংস করতে দেড় শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে’’ জানিয়েছে পত্রিকাটি।
ইরানি হামলার তীব্রতা ইন্টারসেপ্টরের এত বেশি চাহিদা তৈরি করে যে, পেন্টাগন সৌদি আরবের পূর্বের কেনা থাড ইন্টারসেপ্টরগুলিকে ইসরায়েলে সরিয়ে নেওয়ার কথা বিবেচনা করেছিল। তবে ইসরায়েলে ইন্টারসেপ্টর পাঠানোর জন্য মার্কিন অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে সৌদি আরব।
এদিকে, দুই মার্কিন কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে মিডল ইস্ট আই বলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সাহায্য করতে থাড ইন্টারসেপ্টরগুলি হস্তান্তর করতে সৌদি আরবকে অনুরোধ করে। কিন্তু রিয়াদ সেই অনুরোধ নাকচ করে দেয়।
‘‘ইসরায়েলকে সাহায্য করতে সৌদি আরবের অস্বীকৃতি ওয়াশিংটনের কর্মকর্তাদের শরীরে হুল ফুটিয়েছে’’ যোগ করেছে মিডল ইস্ট আই।
মার্কিন দাবির প্রতি সৌদি আরবের ‘না’ ইরানের সঙ্গে গভীর সম্পর্ককে তুলে ধরেছে।
৮ জুলাই সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) জেদ্দায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচির সাথে আলোচনা করেন। বৈঠকে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স ইরানের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে যেকোনো সামরিক আগ্রাসনের নিন্দা করেন। তিনি দুই ইসলামী শক্তির মধ্যে সহযোগিতার পরিবেশ উন্নত হওয়ার বিষয়টিকে স্বাগত জানান।
আরাঘচি, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা করার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল অবস্থানের জন্য সৌদি আরবকে ধন্যবাদ জানান। তিনি সুপ্রতিবেশীসুলভতা এবং পারস্পরিক স্বার্থের নীতির ভিত্তিতে সৌদি আরবসহ সব প্রতিবেশীদের সাথে আরও শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে ইরানের প্রতিশ্রুতির ওপর জোর দেন।
আরাঘচি সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন সালমান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহানের সঙ্গেও আলোচনা করেন। তারা ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সহযোগিতার প্রতি দেশগুলির প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
চীনের মধ্যস্থতা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় ইরান-সৌদি ঐক্যকে এগিয়ে নিয়েছে
মুসলিম দুই প্রভাবশালী দেশের মধ্যে নতুন কূটনৈতিক উষ্ণতা নিহিত রয়েছে ২০২৩ সালে চীনের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তির মধ্যে। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে ইরান এবং সৌদি আরব বছরের পর বছর বিচ্ছিন্নতার পর আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করে। সেই থেকে, চীনের গঠনমূলক মধ্যস্থতা তেহরান এবং রিয়াদকে আরও ঘনিষ্ঠ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
সাম্প্রতিক স্মৃতিতে সবচেয়ে তীব্র ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের ধুলো জমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে শক্তিশালী বন্ধন পশ্চিম এশিয়ায় স্থিতিশীলতার জন্য একটি শক্তিশালী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। দেশ দুটির ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা কেবল এই অঞ্চলের কৌশলগত ভূদৃশ্যকে পুনর্গঠন করছে না- বরং ইসরায়েলি আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট উত্তেজনার চক্রের বিরুদ্ধে একটি আকর্ষণীয় অপশন হিসেবে কাজ করছে।
একসময়ের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, তেহরান এবং রিয়াদ এখন একটি নতুন যুগের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে- যার মূলে রয়েছে সার্বভৌমত্ব, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং যৌথ নিরাপত্তা। দেশ দুটির ঐক্যফ্রন্ট একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠায়: বিদেশি হস্তক্ষেপ বা সামরিকবাদের মাধ্যমে নয়, বরং আঞ্চলিক ঐক্য এবং ভাগ করা স্বার্থের মাধ্যমে আঞ্চলিক শান্তি সর্বোত্তমভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব।
ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার এই সময়ে, ইরান এবং সৌদি আরব প্রমাণ করছে, ইসলামি দেশগুলি বিভক্তির ঊর্ধ্বে উঠে স্থিতিশীলতার স্তম্ভ হয়ে উঠতে পারে, তাদের জনগণকে রক্ষা করতে, আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখতে এবং এই অঞ্চলের শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম। তারা যে পথ বেছে নিয়েছে তা পশ্চিম এশিয়ার ভবিষ্যতকে সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারে।—তেহরান টাইমস
/ইএ

