ইরানের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলের অর্থনীতি মারাত্বক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, কারণ ইতোমধ্যেই দেশটি কয়েকশ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে এবং ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আরও কয়েক বিলিয়ন ডলার লাগতে পারে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, ইরানের ওপর হামলার প্রথম সপ্তাহে ইসরায়েল প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যেখানে যুদ্ধের দৈনিক ব্যয় ৭২৫ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছায়। এর মধ্যে ৫৯৩ মিলিয়ন ডলার ইরানে আক্রমণের জন্য এবং ১৩২ মিলিয়ন ডলার ইরানি হামলা ঠেকাতে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা এবং সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ করা হয়।
বিজ্ঞাপন
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র-বিরোধী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দৈনিক খরচ ১০ মিলিয়ন থেকে ২০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত।
ইসরায়েল-ভিত্তিক অ্যারন ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক পলিসির মতে, এক মাস ধরে এই যুদ্ধ চললে ইসরায়েলের মোট খরচ ১২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হতে পারত।
বিজ্ঞাপন
আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব প্যালেস্টাইনের অর্থ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাসের আবদেলকারিম বলেন, ইরানের হামলাগুলো শুধু ইসরায়েলের সামরিক ব্যয়কেই সরাসরি প্রভাবিত করেনি বরং দেশটির উৎপাদন কার্যক্রমকেও প্রভাবিত করেছে। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধের ফলে ইসরায়েলের ২০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে।
আবদেলকারিম বলেন, ইসরায়েলের বাজেট ঘাটতি ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান দেশের সরকারি অর্থব্যবস্থাকে আরও খারাপ করবে।
ইসরায়েলের কর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম সপ্তাহে ঘরবাড়ি হারানো ইসরায়েলিদের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং প্রায় ৩৬ হাজার ৪৬৫ জন ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করেছেন।
আবদেলকারিম বলেন, ইসরায়েলি সরকার ক্রমবর্ধমান বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য নিম্নলিখিত তিনটি পদক্ষেপের মধ্যে একটি বিবেচনা করছে: স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় সরকারি ব্যয় হ্রাস করা, কর বৃদ্ধি করা অথবা ঋণ গ্রহণ করা, যা জাতীয় আয়ের অনুপাতের সঙ্গে সরকারি ঋণ ৭৫ শতাংশেরও বেশি বাড়িয়ে দিতে পারে।
ইসরায়েলি অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশের বর্তমান আর্থিক সম্পদ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ইতোমধ্যেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আরও ৮৫৭ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দের জন্য অনুরোধ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ থেকে ২০০ মিলিয়ন ডলার কর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলি ব্যবসায়িক সংবাদপত্র গ্লোবস জানিয়েছে, এই তহবিলের বেশিরভাগই সামরিক কর্মীদের খরচ মেটাতে ব্যবহৃত হবে। কারণ যুদ্ধের সময় বৃহৎ পরিসরে সেনাসমাবেশের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার রিজার্ভ সৈন্যকে দায়িত্ব পালনের জন্য ডাকা হয়েছিল।
বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক ইসরায়েলি অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, সংঘাত অব্যাহত থাকলে ইসরায়েলের প্রবৃদ্ধির হার ধীর হতে পারে, বেকারত্ব বাড়তে পারে এবং দারিদ্র্যের হার বাড়তে পারে।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের মতে, ইরান তেল আবিব এবং হাইফায় গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করেছে, যার মধ্যে ইসরায়েলের বৃহত্তম তেল শোধনাগার বাজানও রয়েছে। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ফলে তেল শোধনাগারটি বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে দৈনিক আনুমানিক ৩ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে।
অন্যদিকে, ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলায় তেল আবিবে বেন গুরিওন বিমানবন্দরের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। এই ব্যাঘাতের ফলে আরও বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে। দেশটির বৃহত্তম বিমানবন্দরে প্রতিদিন সাধারণত প্রায় ৩০০টি ফ্লাইট এবং ৩৫ হাজার যাত্রী যাতায়াত করে।
এছাড়াও ইরানি হামলার শঙ্কায় ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা ‘এল আল’ তাদের সব ফ্লাইট স্থগিত করে এবং বিমানগুলোকে অন্যদেশে সরিয়ে নেয়। বিমানগুলোকে স্থানান্তরের এই পরিচালন ব্যয় প্রায় ৬ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে ইসরায়েলের শেয়ার বাজারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূলত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, যা স্বল্পমেয়াদে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
জানা গেছে, ইসরায়েলের ডায়মন্ড এক্সচেঞ্জেও আঘাত হানে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র, যা ইসরায়েলের মোট রপ্তানির প্রায় ৮ শতাংশ। ইসরায়েল ডায়মন্ড ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, এই হামলার ফলে তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জে বড় ধরনের পতন দেখা যায়।
এছাড়াও ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বিরশেবায় অবস্থিত গাভ-ইয়াম অ্যাডভান্সড টেকনোলজি পার্কেও কয়েক দফায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। এটি ইসরায়েলের একটি হাই-টেক বাণিজ্যিক জোন, যেখানে বহু আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি কোম্পানি ও স্টার্টআপের অফিস রয়েছে, যা সামরিক ও গবেষণামূলক কাজেও ব্যবহৃত হয়। ইরানি হামলার ফলে হাইটেক পার্কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
সূত্র: আনাদোলু
এমএইচআর

