মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মধ্য দিয়ে শুরু হলো ট্রাম্প ২.০ বা ট্রাম্পের দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যাত্রা। ‘এই মুহূর্ত থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সোনালি যুগ শুরু হলো।’ এই বাক্য দিয়েই অভিষেক বক্তৃতা শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মাত্র ৩৭ শব্দের শপথ বাক্য পাঠ করে তিনি ক্ষমতায় আরোহণ করলেন।
নানা বিতর্ক আর সমালোচনার মধ্য দিয়ে চার বছর পার করার পর চার বছর আগে হোয়াইট হাউজ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদায় পর্বটি ছিল বেশ অস্বাভাবিক। ভোটের ফল মেনে না নিয়ে ক্যাপিটল হিল ভবনে হামলায় সমর্থকদের প্ররোচিত করে ‘গণতন্ত্রের শত্রু’ তকমা নিয়ে তাকে ছাড়তে হয়েছিল প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব।
বিজ্ঞাপন
তখন কেউ কি ভাবতে পেরেছিল যে চার বছর পর ওয়াশিংটন ডিসির সেই পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটলেই ট্রাম্পের রাজসিক প্রত্যাবর্তন ঘটবে? একবার নয়, দুই বার অভিশংসিত হওয়ার নজির তো গড়েইছিলেন, তারপর একের পর এক কেলেঙ্কারি, মামলায় আদালতের রায়ে দোষি সাব্যস্ত হয়ে ফেরার পথটি বন্ধুরই করে তুলেছিলেন ট্রাম্প।
তার মধ্যেই ভোটের প্রচারে নেমেছিলেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হয়ে। প্রচার সবকিছু ছাপিয়ে গিয়েছিল দু’বার মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ায়। নভেম্বরের ভোটের আগে গত বছরের ১৩ জুলাই পেনসিলভেনিয়ায় নির্বাচনী সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময় গুলিবর্ষণের শিকারও হতে হয় তাকে।
বিজ্ঞাপন
কান ফুটো করে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার পর রক্তাক্ত ট্রাম্প তার সোশাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে লিখেছিলেন- ‘ফাইট, ফাইট ফাইট’। ৭৮ বছর পেরিয়ে আসা ট্রাম্প সেই ‘ফাইট’ চালিয়ে গেছেন শেষ অবধি; তার ফল হিসেবে ভোটে জিতে এসে সোমবার আবার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিলেন তিনি, যা টিভির পর্দা ও অনলাইনে দেখল সারা বিশ্ব।
পার্থক্য শুধু এটুকু যে ২০১৭ সালে ক্যাপিটল ভবনের পশ্চিম প্রাঙ্গণে প্রথা অনুযায়ী খোলা লনে শপথ নিয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু এবার বিরূপ আবহাওয়ার কারণে অনুষ্ঠানটি সরিয়ে নেওয়া হয় এই কমপ্লেক্সের প্রাণকেন্দ্র ক্যাপিটল রাউটেন্ডা হলে। শীতল আবহাওয়ার কারণে সর্বশেষ ১৯৮৫ সালে রোনাল্ড রেগানের দ্বিতীয় মেয়াদের শপথ অনুষ্ঠানে এভাবে বন্ধ ঘরে করতে হয়েছিল।
এবার শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সী প্রেসিডেন্টের রেকর্ডটি গড়লেন ট্রাম্প। শুধু তাই নয়, একবার হারের পর আবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ফেরার ঘটনাও যুক্তরাষ্ট্রবাসী দেখল ঊনবিংশ শতকের পর এই প্রথমবার। শুধু তাই নয়, আগের চেয়ে বেশি শক্তিমান হয়েই প্রেসিডেন্টের চেয়ারে ফিরলেন ট্রাম্প।
এবার শপথ নিয়েই ট্রাম্প বলেছেন, আমেরিকার সোনালি যুগের সূচনা হলো। যুক্তরাষ্ট্রকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করবো এবং তা অতি দ্রুতই করবো।
দু’বার প্রাণে বেঁচে যাওয়ার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, স্রষ্টা আমাকে দিয়ে আমেরিকাকে আবার মহান করতে চাইছেন বলেই আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন।
মূল্যস্ফীতি কমিয়ে জনগণকে স্বস্তি দেওয়ার পাশাপাশি বাণিজ্য নীতির খোল নলচে বদলে দেওয়ার ঘোষণাও অভিষেক ভাষণে দেন তিনি।
এবার ইলেকটোরাল ভোটের পাশাপাশি পপুলার ভোটেও এগিয়ে ছিলেন ট্রাম্প। সেনেট ও প্রতিনিধি পরিষদেও এখন তার দল রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ককে তো সরকারি পদ দিয়েছেনই, পাশাপাশি অন্য সব টেক জায়ান্টদের পাশাপাশি ধনকুবেরদের এনেছেন পাশে। সব মিলিয়ে ট্রাম্পের আশপাশে ধনীদের চাঁদের হাট বসলেও বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আশঙ্কা করে গেছেন, এবার অলিগার্কদের হাতে যাবে যুক্তরাষ্ট্রবাসীর ভাগ্য।
‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগান নিয়ে শীতল এক দিনে হোয়াইট হাউজে ফেরা ট্রাম্প শপথ নেওয়ার প্রথম দিনেই নির্বাহী আদেশের ফাইল সই করার ঝড় বইয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনে ‘ওবামা কেয়ার’ বাতিলের এক আদেশেই কেবল সই করেছিলেন তিনি। সেখানে এবার ১০টিরও বেশি আদেশে সই করার কথা বলেই রেখেছেন।
মূল্যস্ফীতির চাপে জেরবার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা ডেমোক্রেটদের বদলে ধনকুবের ব্যবসায়ী ট্রাম্পকে আনার ক্ষেত্রে বিশ্বের নানা প্রান্তে তার যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতিতেও মজেছিল। তার শপথ নেওয়ার ঠিক আগেই ইসরায়েলের সঙ্গে হামাসের যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প তাদের সেই আশার পালে হাওয়া দিলেন। তবে আরও কাজে তাকে দিতে হবে প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রমাণ।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান
প্রচণ্ড শীতের মধ্যে ট্রাম্পের অভিষেকের উষ্ণ আয়োজনটি হয় ওয়াশিংটন ডিসির পার্লামেন্ট কমপ্লেক্স ক্যাপিটলের মধ্যস্থলের রাউটেন্ডা হলে।
সোমবার দুপুর ১২টায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্টবৃন্দসহ আমন্ত্রিত অতিথিদের উপস্থিতির মধ্যে এই শপথ অনুষ্ঠান হয়।
অনুষ্ঠানে আগে শপথ নেন নতুন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্স। তিনি শপথ বাক্য পাঠ করার পর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে শপথ পড়ান যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস।
কালো কোট, মেরুন রঙের টাই পরে দুটি বাইবেলে বাম হাত রেখে শপথ বাক্য পড়েন ট্রাম্প। এই বাইবেল দুটির একটি যুক্তরাষ্ট্রের ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের, আরেকটি তার নিজের।
বাইবেল দুটি দু’হাতে ধরেছিলেন তার স্ত্রী ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প। কালো ওভার কোট পরা মেলানিয়ার মাথায় ছিল কালো রঙের হ্যাট।
এই শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, জর্জ ডাব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা। ক্লিনটনের সঙ্গে তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও ছিলেন অনুষ্ঠানে, ২০১৬ সালের নির্বাচনে যাকে হারিয়ে প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ট্রাম্প।
বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বিদায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসও ছিলেন অনুষ্ঠানে। ২০২০ সালের নির্বাচনে বাইডেনের কাছে হেরেই হোয়াইট হাউজ ছাড়তে হয়েছিল ট্রাম্পকে, আর গত নভেম্বরের নির্বাচনে কমলা হ্যারিসকে হারিয়েই প্রত্যাবর্তন করলেন তিনি।
যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, স্পেসএক্স’র কর্ণধার ইলন মাস্ক, ফেইসবুকের কর্ণধার মার্ক জাকারবার্গ, অ্যামাজনের কর্ণধার জেফ বেজোস ছিলেন অনুষ্ঠানে।
শপথের দিন সকালেই ট্রাম্প এবং তার স্ত্রী মেলানিয়া পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে সেন্ট জন গির্জায় যান প্রার্থনা করতে। নবনির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স এবং তার ভারতীয় বংশোদ্ভূত স্ত্রী উষা ভ্যান্সও ছিলেন সেখানে।
ট্রাম্প ও মেলানিয়া প্রার্থনা সেরে যান হোয়াইট হাউজে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেনের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাতে।
এরপর ট্রাম্প যান ক্যাপিটল ভবনে শপথ নিতে। শপথ নেওয়ার পরপরই তিনি অভিষেক ভাষণ দেন। তারপর কংগ্রেসের দেওয়া মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নেন তিনি।
ক্যাপিটল ভবন থেকে ট্রাম্প যাবেন ক্যাপিটল ওয়ান এরেনায়; এবার বদ্ধ ঘরে শপথ অনুষ্ঠান হওয়ায় সবার তা দেখার জন্য ইনডোর স্টেডিয়ামটিতে ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে ভাষণ দেওয়ার পর প্যারেড নিয়ে ট্রাম্প যাবেন হোয়াইট হাউজে, সেখানে ওভাল অফিসে প্রথম দিনেই তিনি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষরের ঝড় বইয়ে দেবেন বলে আগেই জানিয়েছেন।
এফএ

