শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

ইরান-পাকিস্তান উত্তেজনা কেন, কারা এই জাইশ আল-আদল?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:২৮ পিএম

শেয়ার করুন:

ইরান-পাকিস্তান উত্তেজনা কেন, কারা এই জাইশ আল-আদল?
ছবি: সংগৃহীত

উগ্রগোষ্ঠী জাইশ আল-আদলকে লক্ষ্য করে ইরানের সাম্প্রতিক হামলা পর মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাত সীমানা ছাপিয়ে অন্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইসলামাবাদ জানিয়েছে, ওই দিনের হামলায় দুই শিশু নিহত হয়েছিল। এছাড়া আহত হয়েছিল আরও তিনজন। 

দেশটি বলেছে, সাম্প্রতিক এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। একই সাথে ‘কোনো ধরনের উস্কানি ছাড়াই’ আকাশসীমা লঙ্ঘনের এই ঘটনার বদলা নেওয়া হতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে।


বিজ্ঞাপন


তবে ইরান দাবি করেছে, জাইশ আল-আদল নামে একটি উগ্রগোষ্ঠী পাকিস্তান-ইরান সীমান্তে সক্রিয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল তাদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে। অতীতে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বেশ কয়েকটি হামলার দায় স্বীকার করেছে এই গোষ্ঠীটি।

জাইশ আল-আদল বা ‘ন্যায়বিচারের যোদ্ধা’
জাইশ আল-আদল বা ‘ন্যায়বিচার ও সমতার পক্ষে যোদ্ধা’ হচ্ছে একটি উগ্রগোষ্ঠী। যারা ইরানের সরকারের বিরোধিতা করে। এই গোষ্ঠীটি নিজেদের ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে ‘সুন্নি অধিকার রক্ষক’ হিসেবে বর্ণনা করে থাকে।

২০০৯ সালে ইরান আব্দলমালেক রিগি নামে একজনকে গ্রেফতার করে। তিনি এই উগ্রগোষ্ঠীটির প্রধান। এর আগে এই গোষ্ঠীটি জানদাল্লাহ বা আল্লাহর যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিল।

আরও পড়ুন
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পাকিস্তানে ২ শিশু নিহত

আব্দলমালেক রিগির বিরুদ্ধে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বোমা হামলা চালানো এবং যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ট হিসেবে কাজ করার অভিযোগ আনা হয়। ২০১০ সালে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সে সময় ইরানে নিয়োজিত থাকা পাকিস্তানের সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ আব্বাসি বলেছিলেন, রিগির গ্রেফতারে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা বলছে, ইরানে বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণ এবং হামলার পেছনে জাইশ আল-আদলের হাত রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে ২০০৫ সালে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের ওপর হামলা।

জাইশ আল-আদল যেসব হামলার দায় স্বীকার করেছে তাদের মধ্যে বেশির ভাগই সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে চালানো হয়েছে।

ইরান কেন পাকিস্তানে হামলা চালাল?
ইরানের সামরিক বাহিনী বা রিভলিউশনারি গার্ড কোর ইরাক এবং সিরিয়ায় বিভিন্ন লক্ষ্যে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা চালানোর পরের দিনই এই বিমান হামলা চালানো হয়।

পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞ মুশাহিদ হুসাইন সাইদ বলেন, এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের জন্য বিস্ময়কর ছিল। আমার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আপাতত দেখে মনে হচ্ছে, এটা ইরানের সামরিক বাহিনী রিভলিউশনারি গার্ড কোরের গোপন অভিযান এবং এটি অবশ্যই আরও বিস্তৃতভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে। 

আরও পড়ুন
ইরানের হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের তীব্র নিন্দা

তিনি আরও দাবি করেন, এই হামলা দ্বিপক্ষীয় চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক প্রটোকলের লঙ্ঘন। একই সাথে এটি এমন এক সময়ে ইসলামী ঐক্যের চেতনাকে ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা যখন গাজায় একটি গণহত্যা চালানো হচ্ছে।

তিনি বলেন, ইসরায়েলের প্রতি হতাশা প্রকাশ করার পরিবর্তে তেহরান গত চব্বিশ ঘণ্টায় তিনটি মুসলিম দেশের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ ধরনের ভণ্ডামি এবং দ্বিচারিতার তীব্র নিন্দা করা উচিত। 

পাকিস্তান-ইরান উত্তেজনা
ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্কে সুসময় ও দুঃসময়-দুটোই ছিল। ইরানই প্রথম দেশ হিসেবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং বিদেশে পাকিস্তানের প্রথম দূতাবাসও ইরানে স্থাপন করা হয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সময় দুই দেশ পরস্পরকে সহায়তা করেছে এবং ভূ-রাজনীতিতে তারা ব্যাপকভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল।

১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তেহরান ইসলামাবাদকে সমর্থন দিয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সশস্ত্র লড়াই ১৯৬৫ সালের অগাস্টে শুরু হয়ে ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলেছিল।

যাই হোক ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব এবং পাকিস্তানে সৌদি-অনুপ্রাণিত ওয়াহাবি ধারার ইসলাম চর্চা বাড়তে থাকলে ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়তে থাকে।

আরও পড়ুন
ইরানের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করল পাকিস্তান

১৯৯০ এর দশকে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতা এবং শিয়া ছায়াযুদ্ধে উস্কানি দেওয়ার জন্য ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়। আর অন্য দিকে এই সময়ে কাবুলভিত্তিক তালেবান সরকারকে ইসলামাবাদের সমর্থন দেওয়া নিয়ে অস্বস্তি ছিল তেহরানের।

ভারতের সাথে ইরানের সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ওয়াশিংটনের সাথে পাকিস্তানের কৌশলগত মিত্রতা বাড়ানোর বিষয়টি দুই দেশকে পরস্পর থেকে আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছে।

২০১৮ সালে ইরান যখন চাবাহার নামে দেশটির সমুদ্র বন্দরের একাংশের নিয়ন্ত্রণ নয়াদিল্লির হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে ভারতের সাথে একটি চুক্তি সই করে, তখন ইসলামাবাদ এটি নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেছিল।

পাকিস্তানে এই বিষয়টিকে গোওয়াদার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব কমিয়ে আনতে ভারত ও ইরানের একটি পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছিল। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে গোওয়াদার বন্দর। এত সব অবনতির মধ্যেও দুই দেশ বড় কোনো দ্বন্দ্বে জড়ায়নি। আবার তারা তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কখনো ব্যবহারও করেনি।

ইসলামাবাদের ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা ফেলো আরহামা সিদ্দিকা বলেন, ২০২১ সাল থেকে দুই দেশের সম্পর্ক বেশ ইতিবাচকভাবেই এগিয়ে চলছিল। কিন্তু তারপরও পাকিস্তান বেশ সতর্কতার সাথেই পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল।

আরহামা সিদ্দিকা বলেন, পাকিস্তান তার ভূখণ্ডের অখণ্ডতার বিষয়ে কোনো ছাড় দিতে পারবে না। কিন্তু একই সাথে তারা আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র উন্মুক্ত করতে চায় না। ভারত ও আফগানিস্তানের সাথে এরই মধ্যে তাদের সম্পর্ক খারাপ। ইসলামাবাদ আরেক প্রতিবেশীর সাথেও সম্পর্ক খারাপ করতে চাইবে না।

আরও পড়ুন
ইরানে পাকিস্তানের পাল্টা হামলা, নিহত ৭

ইকরাম সেহগাল নামে একজন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক বলেন, পাকিস্তান এই পর্যন্ত ইরানের সাথে যথাযথভাবেই সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে।

এমনও সময় ছিল যখন পাকিস্তান সৌদি শিবিরের অংশ হতে চায়নি। বিশেষ করে ২০১৫ সালে যখন সৌদির নেতৃত্বে সুন্নি জোট ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে তখন পাকিস্তানের অংশ হতে অসম্মতি জানায়।

পাকিস্তান তখন বুঝতে পেরেছিল, আঞ্চলিক সাম্প্রদায়িক সংঘাতে জড়ালে তার বিপদ হচ্ছে, দেশের মধ্যে শিয়া ও সুন্নি জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন একটি লড়াই ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। তবে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সাম্প্রতিক সুসম্পর্ক এই চাপ কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে।

ইকরাম সেহগাল বিশ্বাস করেন, ইরান বোঝে যে তারা আরেকটি প্রতিবেশীর সাথে নতুন করে আরেকটি যুদ্ধাবস্থা শুরু করতে পারবে না কারণ দেশটি এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িয়ে রয়েছে। এছাড়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখেও বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে দেশটিকে।

তিনি মনে করেন, পাকিস্তানের উচিত উগ্রগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া এবং অন্য দেশে হামলা চালাতে নিজের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না দেওয়া।

ইকরাম সেহগাল বলেন, ইরানেরও এ ধরনের বিপর্যয়মূলক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। তাদের উচিত যোগাযোগ করে সমন্বয় করা। তা না হলে, এ ধরনের পদক্ষেপ এই অঞ্চলটিকে আরেকটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে যা এই অঞ্চলের মানুষ সহ্য করতে পারবে না। সূত্র: বিবিসি

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর