গাজার অর্ধেক জনগোষ্ঠীই এখন অভুক্ত। জাতিসংঘের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘গাজায় এখনও যুদ্ধ চলছে এবং সেখানকার অর্ধেক জনগোষ্ঠীই প্রচণ্ড খাদ্যাভাবে আছে।’
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর কার্ল স্কাউ বলেছেন, এখানে প্রতিদিন মোট যে পরিমাণ খাদ্য সাহায্য দরকার তার খুব সামান্য পরিমাণই কেবল এখানে প্রবেশ করতে পারছে। গাজায় প্রতি দশজনের ৯ জনই দৈনিক ঠিকমতো খাবার পাচ্ছেন না।
বিজ্ঞাপন
ইসরায়েল গাজার বর্তমান পরিস্থিতিতে সহায়তা পৌঁছানোর বিষয়টি ‘প্রায় অসম্ভব’ করে তুলেছে বলে জানান স্কাউ।
আরও পড়ুন: গাজার অর্ধেক জনগোষ্ঠীই এখন অভুক্ত: জাতিসংঘ
শনিবার ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স-আইডিএফের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিচার্ড হেক্ট বলেন, ‘যেকোনো মৃত্যু এবং বেসামরিক মানুষের দুর্ভোগ খুবই কষ্টের, কিন্তু আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। গাজা উপত্যকার যতোটা সম্ভব ভেতরে প্রবেশের জন্য আমাদের যা করা দরকার আমরা তার সবই করছি।’
এক ভিডিওতে দেখা যায় আইডিএফের চিফ অফ স্টাফ হার্জি হালেভি তার সৈন্যদের বলছেন “আক্রমণের ধার আরও বাড়াতে” কারণ “আমরা দেখতে পাচ্ছি যে উগ্রবাদীরা আত্মসমর্পণ করছে...যাতে বোঝা যায় তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়ছে।”
অন্যদিকে, বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলের কাছে ১০৬ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের প্রায় ১৪ হাজার রাউন্ড ট্যাঙ্কের গোলাবারুদ বিক্রি করার জন্য এক জরুরি আইন ব্যবহার করে কংগ্রেসে সেটি পাস করিয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের কড়া সীমান্ত নিরাপত্তা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ১২০০ জন ইসরায়েলিকে হত্যা এবং ২৪০ জনকে জিম্মি করে নিয়ে আসে।
এরপর থেকেই ইসরায়েল গাজার সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে, সেখানে বিমান হামলা শুরু করে এবং গাজায় প্রবেশাধিকার একেবারে সীমিত হয়ে পড়ে।
সেখানে সাহায্য বহনকারী পরিবহন - যার ওপর গাজাবাসী প্রচন্ড নির্ভরশীল তার চলাচলও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: ইসরায়েলি সামরিক অবস্থানে ফিলিস্তিনিদের ভয়াবহ হামলা
হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ইসরায়েল গাজায় ১৭,৭০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে, যার মধ্যে সাত হাজারের বেশি শিশু।
শুধুমাত্র মিসরের রাফাহ সীমান্ত এখন পর্যন্ত খোলা আছে, যেখান দিয়ে অল্প কিছু সহায়তা ঢুকছে।
চলতি সপ্তাহে ইসরায়েল কেরেম শ্যালম সীমান্ত খুলে দিতে রাজি হয়েছে – কিন্তু সেটা শুধুমাত্র ত্রাণবাহী লরি পরীক্ষা করে দেখার জন্য। এখান থেকে ট্রাকগুলো পরে রাফাহ দিয়ে গাজায় ঢুকবে।
স্কাউ বলেন, গাজায় এসে তিনি ও তার ডব্লিউএফপির দল “যে ভীতি, বিশৃঙ্খলা আর হতাশার মুখোমুখি হতে হয়েছে” তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না তারা।
তিনি বলেছেন, তারা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন “গুদামের জিনিসপত্র নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতার, সেসব বিতরণ করতে গিয়ে হাজারো মরিয়া ক্ষুধার্ত মানুষের, সুপারমার্কেটের শূন্য তাক ও আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের অতিরিক্ত চাপ।”
আন্তর্জাতিক চাপ এবং গত মাসে সাত দিনের একটা সাময়িক যুদ্ধবিরতি গাজার জন্য ভীষণ দরকারি, কিছু জরুরি সাহায্য ঢোকার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু ডব্লিউএফপি মনে করে এই মূহুর্তে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য আরেকটা দ্বিতীয় সীমান্ত খুলে দেওয়া খুবই জরুরি।
স্কাউ বলেন, গাজার প্রতি দশটি পরিবারের মধ্যে ৯টিই ‘একটা গোটা দিন ও রাত কোনরকম খাবার ছাড়াই পার করছে’।
গাজার দক্ষিণের শহর খান ইউনিস যেটাকে ঘিরে আছে ইসরায়েলি ট্যাঙ্কের দু’টি ফ্রন্ট, সেখানকার মানুষেরা জানাচ্ছেন পরিস্থিতি ক্রমশই খারাপ হচ্ছে সেখানে।
এই শহরে যে হাসপাতালটি এখনও টিকে আছে - সেই আল নাসেরের প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন ইউনিটের প্রধান ড. আহমেদ মুঘরাবি বিবিসির কাছে খাদ্য সংকট নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কান্না আটকাতে পারেননি।
“আমার একটা তিন বছর বয়সী মেয়ে আছে, সে আমাকে সবসময় কিছু মিষ্টি, আপেল ও ফলমূল নিয়ে আসতে বলে। আমার খুবই অসহায় লাগে,” বলেন তিনি।
“এখানে পর্যাপ্ত খাবার নেই, শুধুমাত্র ভাত আছে, শুধু ভাত আছে বিশ্বাস করতে পারেন আপনি? আমরা দিনে মাত্র একবার খাই।”
সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলি বিমান হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়েছে খান ইউনিস। এমন সময়ে নাসের হাসপাতালের প্রধান বিবিসিকে জানিয়েছেন, ঠিক কী পরিমাণ মৃত ও আহত ব্যক্তি প্রতিদিন তাদের এখানে আসছে সেই হিসাব তার দল আর রাখতে পারছে না।
ইসরায়েলের দাবি হামাস নেতারা সম্ভবত খান ইউনিসের মাটির নিচে টানেলের মধ্যে লুকিয়ে আছে এবং তারা এই গোষ্ঠীর সামরিক সামর্থ্য ধ্বংস করার জন্য ঘরে ঘরে যুদ্ধ করে যাচ্ছে।
শনিবার গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রশ্নে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেওয়ার পর, ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস দেশটিকে যুদ্ধাপরাধের সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত করেন।
নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য দেশের মধ্যে ১৩টি দেশই গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দেয়। যুক্তরাজ্য নিজেদের ভোট প্রদানে বিরত রাখে আর যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র দেশ হিসেবে এর বিপক্ষে ভোট দেয়।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রধান আব্বাস বলেন, “গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ফিলিস্তিনি শিশু, নারী ও বয়স্কদের রক্ত ঝরার জন্য যুক্তরাষ্ট্র দায়ী।”
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের দূত রবার্ট উড ভেটো প্রদানের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন “অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির” এই রেজ্যুলেশন পাস হলে “হামাস আবারও ওই একই ঘটনা ঘটাতে পারে - যেটা তারা ৭ অক্টোবর করেছিল।”
নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র “সঠিক পদক্ষেপ” নিয়েছে বলে এর প্রশংসা করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
সাত দিনের সাময়িক যুদ্ধবিরতি শেষ হয়েছে সপ্তাহখানেক আগে। এই শান্তিচুক্তির সময় হামাস ৭৮জন বন্দী বিনিময় করে ইসরায়েলের কারাগারে আটক থাকা ১৮০ জন ফিলিস্তিনির সঙ্গে।
এখনও গাজায় হামাসের হাতে বন্দী আছে এক শ’-এর বেশি ইসরায়েলি।
শনিবার তাদের মধ্যে ২৫ বছর বয়সী একজন বন্দী সাহার বারুখকে হত্যা করা হয়েছে বলে এক বিবৃতিতে নিশ্চিত করেছে তার সম্প্রদায় ও বন্দীদের পরিজনদের নিয়ে গঠিত একটা গ্রুপ।
এই ঘটনাটা ঘটে যখন হামাসের একটা সশস্ত্র শাখা শুক্রবার এক রক্তাক্ত শরীরের ভিডিও প্রকাশ করে এবং বলে যে এই বন্দীর মুক্তির চেষ্টায় আইডিএফের অভিযান ব্যর্থ হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি
এমইউ