নাগোর্নো-কারাবাখে আজারবাইজানের সার্বভৌমত্ব পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ। ওই অঞ্চলের জাতিগত আর্মেনিয়ান বাহিনীর বিরুদ্ধে ২৪ ঘণ্টার সামরিক অভিযানের পর তিনি এ ঘোষণা দেন।
কারাবাখ বাহিনী আত্মসমর্পনে রাজি হওয়ার পর আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ তার দেশের সেনাবাহিনীর ‘বীরত্বে’র প্রশংসা করেছেন।
বিজ্ঞাপন
প্রায় এক লাখ বিশ হাজার আর্মেনিয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ দক্ষিণ ককেশাস ছিটমহলে বাস করেন, যেটি আন্তর্জাতিকভাবে আজারবাইজানের অংশ হিসেবে স্বীকৃত। দেশটি এখন পুরো অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী।
মঙ্গলবার দেশটির সামরিক বাহিনী সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে এবং দাবি করে যে কারাবাখ বাহিনী সাদা পতাকা উত্তোলন করেছে এবং তাদের ‘অবৈধ রাজত্বের’ অবসান ঘটিয়েছে।
প্রতিবেশী আর্মেনিয়ার কোনো সমর্থন ছাড়াই প্রায় ৯ মাসের কার্যকর একটি অবরোধের পর আর্মেনিয় নৃগোষ্ঠীর লোকেরা হাল ছেড়ে দেয়।
বিজ্ঞাপন
তবে আর্মেনিয়ার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে সাত জন বেসামরিক নাগরিকসহ অন্তত ৩২ জন নিহত হয়েছেন আর আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২০০ জন।
বিচ্ছিন্নতাবাদী আর্মেনিয়ানদের মানবাধিকার বিষয়ক একজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন যে অন্তত ২০০ জন নিহত হয়েছেন আর আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৪০০ মানুষ।
তবে বিবিসি এসব সংখ্যাকে নিরপেক্ষ কোনো সূত্র থেকে যাচাই করতে পারেনি।
বুধবার সন্ধ্যায় আর্মেনিয়ার কর্মকর্তারা যুদ্ধবিরতির পরেও দু’দেশের সীমান্তে গোলাগুলির জন্য আজারবাইজানকে অভিযুক্ত করে, তবে দেশটি সঙ্গে সঙ্গেই এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
ওদিকে আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে হাজার হাজার মানুষ সংকট নিরসনে ব্যর্থতার জন্য প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনইয়ানের পদত্যাগের দাবি করে বিক্ষোভ করেছে।
আজারবাইজানের সেনাবাহিনী বলেছে, উভয় পক্ষ যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হওয়ার আগেই তারা জাতিগত আর্মেনিয়ানদের কাছ থেকে অন্তত ৯০ টি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
ওই এলাকায় আগে থেকেই থাকা রাশিয়ান শান্তিরক্ষীদের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
আজারবাইজান ও রাশিয়ার তৈরি করা যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী কারাবাখের স্থানীয় বাহিনীকে পুরোপুরি বাতিল ও নিরস্ত্র করতে হবে।
একইসাথে আর্মেনিয়ার বাহিনীকেও সেখান থেকে সরে যেতে হবে। যদিও আর্মেনিয়া বরাবরই সেখানে তার সামরিক উপস্থিতির কথা অস্বীকার করে আসছে।
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট অফিস থেকে বলা হয়েছে যে কর্মকর্তারা বৃহস্পতিবার ইয়েভলাখ শহরে কারাবাখের আর্মেনিয়ান প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে।
প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ বলেছেন, আজারবাইজান ওই অঞ্চলের জনগণের বিরুদ্ধে নয়, শুধু ‘ক্রিমিনাল জান্তা’র বিরুদ্ধে।
কারাবাখের আঞ্চলিক রাজধানী খানকেন্দির প্রায় এক শ’ কিলোমিটার উত্তরে হলো ইয়েভলাখ শহর। এটি আর্মেনিয়ানদের কাছে স্টেপনাকার্ট নামে পরিচিত।
বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছে বেসামরিক নাগরিকরা
কারাবাখের একজন সাংবাদিক মারুত ভেনিয়ান জানিয়েছেন, ‘বহু মানুষ মঙ্গলবার রাত বাড়ির বেজমেন্টে কাটিয়েছে। আমি ঘুমাতে পারিনি এবং কিছু খাইনি। এখন পরিস্থিতি শান্ত, কিন্তু ভয়ের পরিবেশ বিরাজ করছে। এখনি রক্তপাত বন্ধ হওয়া দরকার।’
রাশিয়া বলছে, তাদের শান্তিরক্ষীরা অন্তত দু’হাজার মানুষকে কারাবাখের গ্রামীণ এলাকা থেকে সরিয়ে নিয়েছে।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরে কারাবাখের কর্মকর্তারা মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রেই থাকতে এবং বিমানবন্দরের দিকে না যেতে বলেছেন।
কারনেজি ইউরোপের ককেশাস বিশেষজ্ঞ থমাস ডি ওয়াল বলেছেন, যুদ্ধবিরতির শর্ত ও আলোচনা সবই হচ্ছে আজারবাইজানের পক্ষে এবং সেখানে আর্মেনিয়ানদের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়নি।
‘দু:খজনকভাবে আমরা এমন একটি বিষয় দেখছি যাতে কারাবাখের আর্মেনিয়ানদের জন্য আজারবাইজান অল্প কিছুই অফার করেছে। ফলে সবাই না হলেও অধিকাংশই ওই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হবে।’
আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনইয়ান বলেছেন, এই যুদ্ধবিরতি বিষয়ে এবং মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি রাশিয়ান শান্তিরক্ষীদের দায়িত্বে দেওয়ার দাবির বিষয়ে তার দেশের কোনো যোগসাজশ নেই।
মঙ্গলবার তিনি কারাবাখে জাতিগত নিধনের অভিযোগ এনেছিলেন আজারবাইজানের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন: নাগর্নো-কারাবাখে যুদ্ধবিরতির কথা নিশ্চিত করলো আজারবাইজান
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের একজন দূত বিবিসিকে বলেছেন, রাশিয়ানরা যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সহযোগিতা করেছে। “আমি মনে করি এখন তাদের এই চুক্তি কার্যকরের বিষয়টি দেখতে হবে।”
চলমান সংকট
নাগোর্নো-কারাবাখ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে গত চার দশক ধরে দ্বন্দ্বে লিপ্ত আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া । নাগোর্নো-কারাবাখ আজারবাইজানের বলেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রণ করে জাতিগত আর্মেনিয়ানরা।
২০২০ সালে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধ হয় যাতে কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়। তবে তুরস্কের সহায়তায় আজারবাইজান ছিটমহল এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জাতিগত আর্মেনিয়ানদের এক জায়গায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
গত ৯ মাস আর্মেনিয়া থেকে কারাবাখে যাওয়ার একমাত্র সড়কটি আজারবাইজান বন্ধ করে রেখেছিলো। এ পথটি লাচিন করিডোর হিসেবেও পরিচিত।
এর ফলে ছিটমহলগুলোতে থাকা জাতিগত আর্মেনিয়ানরা খাদ্য ও ঔষধসহ দরকারি জিনিসপত্রের সংকটের কথা বলছিল। কারণ আর্মেনিয়া তাদের সহায়তা করতে পারছিল না।
তবে সম্প্রতি কিছু ত্রাণ সহায়তা সেখানে নেওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়।
২০২০ সাল থেকে প্রায় দু’হাজার রাশিয়ান শান্তিরক্ষী ওই এলাকায় অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ানদের আগ্রহ কিছুটা কমে যায়।
গত মে মাসে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বলা হয় যে তার দেশ কারাবাখকে আজারবাইজানের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি আছে। বিনিময়ে তিনি জাতিগত আর্মেনিয়ানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানান।
তবে পাশিনইয়ানের পশ্চিমা সংশ্লিষ্টতায় ক্ষুব্ধ হয় রাশিয়া।
তবে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাশিয়ার সমস্যা নেই। “আর্মেনিয়ানরা নিজেরা যদি বলে যে কারাবাখ আজারবাইজানের অংশ, তাহলে আমাদের কী করার আছে?”
তবে আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভেনের শত শত মানুষ দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে।
নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চল:
* ৪,৪০০ বর্গ কিলোমিটার (১,৭০০ বর্গ মাইল) আয়তনের একটি পার্বত্যঞ্চল।
* ঐতিহাসিকভাবে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আর্মেনিয়ান এবং মুসলিম তুর্কদের আবাসস্থল।
* সোভিয়েত আমলে আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পায়।
* আন্তর্জাতিকভাবে আজারবাইজানের অংশ হিসেবে স্বীকৃত, কিন্তু জনসংখ্যার অধিকাংশই জাতিগত আর্মেনিয়ান।
* ১৯৮৮-৯৪ সালের যুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয় এবং প্রায় ৩০ হাজার মানুষ মারা যায়।
* ১৯৯০-এর যুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনী আজারবাইজানের কাছের ছিটমহলের কাছে কিছু জায়গা দখল করে।
* ১৯৯৪ সালের যুদ্ধবিরতির পর থেকে অনেকটাই অচল অবস্থা বিরাজ করছিল।
* আর্মেনিয়ায় রাশিয়ার সেনা ঘাঁটি রয়েছে।
সূত্র : বিবিসি
এমইউ

