মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

সৌদি আরব, ইরানসহ নতুন ছয়টি দেশকে কেন সদস্য করল ব্রিকস?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:১২ পিএম

শেয়ার করুন:

সৌদি আরব, ইরানসহ নতুন ছয়টি দেশকে কেন সদস্য করল ব্রিকস?
(বাম থেকে) লুলা দা সিলভা, শি জিনপিং, সিরিল রামাফোসা, নরেন্দ্র মোদি ও সের্গেই ল্যাভরভ। ছবি: রয়টার্স

উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর সংস্থা ব্রিকস অর্থনৈতিক জোট নতুন করে ছয়টি দেশকে সদস্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৃহস্পতিবার দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা এ তথ্য দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক জোট ব্রিকস তাদের সদস্যপদের জন্য ৪০টি দেশ আবেদন করলেও সৌদি আরব, ইরান ও ইথিওপিয়া-সহ ছয়টি দেশকে নতুন সদস্য হিসেবে বেছে নেওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে যে কিসের ভিত্তিতে এবং কোন প্রক্রিয়ায় এ দেশগুলোকে বাছাই করা হলো।

সদস্যপদ পাওয়া অন্য দেশগুলো হলো - সংযুক্ত আরব আমিরাত, আর্জেন্টিনা ও মিসর। বিশ্লেষকদের ধারণা, নতুন সদস্য করার ক্ষেত্রে দু’টো বিষয় কাজ করতে পারে।


বিজ্ঞাপন


প্রথমত, বৈশ্বিক রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কিছু সূচককে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নতুন সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে।

দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিগুলোকেও এই সংস্থায় আনার একটি প্রচেষ্টার প্রকাশ ঘটেছে এবারের সিদ্ধান্তে।

যদিও জানা যাচ্ছে যে ব্রিকসের এই সম্প্রসারণ কীভাবে হবে তা নিয়ে কয়েক ধাপে আলোচনা হয়েছে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে।

দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকসের ১৫তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো

সেখানে এটি আদৌ সম্প্রসারণ করা যাবে কিনা তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তবে সে আলোচনায় কোনো চাপ ছিল কিনা কিংবা কোনো দেশের দিক থেকে বেশি আগ্রহ ছিল কিনা সেটি পরিষ্কার নয়।

“দুই তিন ধাপে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে হয়তো কারও কারও চাপ ছিলো বা আগ্রহ ছিলো যে সম্প্রসারণ করব। কিন্তু এ বিষয়ে সবাই যে একমত হয়েই সব করেছে তাও হয়তো হয়নি," বলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

তিনি বলেন, "তবে আলোচনা করেই কিছু সূচকের ভিত্তিতেই হয়তো তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” 

ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা - এই দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত জোটই হলো ব্রিকস। প্রথমে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনকে নিয়ে প্রথম সম্মেলন হয়েছিল ২০০৯ সালে।

পরে সেই সম্মেলনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে এ জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হলে এর নাম হয় ব্রিকস। এই জোট ২০১৫ সালে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে।

এবার দক্ষিণ আফ্রিকাতেই এর শীর্ষ সম্মেলন হলো এবং সেই সম্মেলন থেকেই নতুন ছয়টি দেশকে সদস্যপদ দেওয়ার ঘোষণা এসেছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা জানিয়েছেন, নতুন দেশগুলোর সদস্যপদ ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।

দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, ব্রিকসের সম্প্রসারণ মূলত রাশিয়া ও চীনের জয়। কারণ তারা পশ্চিমাবিরোধী জোট হিসেবে এটিকে শক্তিশালী করতে চায়।

ছয়টি দেশ কীসের ভিত্তিতে?

দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে চলতি বছরের জুনে ব্রিকস জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে অগাস্টে শীর্ষ সম্মেলন থেকেই নতুন সদস্যপদ দেওয়ার ঘোষণা হবে।

ওই সম্মেলন থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে বিশ্বব্যবস্থার এক নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ডাক দেওয়া হয়েছিল। এ কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বড় অর্থনীতি বা অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশগুলো সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন ব্রিকস নেতারা

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, ‘প্রথমে আলোচনা হয়েছে জোটটি সম্প্রসারণ করা হবে কিনা। এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের পর আলোচনায় এসেছে কিসের ভিত্তিতে গ্রহণ করা হবে। সেখানে ইথিওপিয়া ছাড়া অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে অর্থনীতির আকার কিংবা মাথাপিছু আয়ের মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’

যদিও এর বাইরেও বৈশ্বিক রাজনীতির বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, নতুন সদস্যপদ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভেনেজুয়েলার মতো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা দেশগুলোকে সদস্যপদ না দেওয়ার পক্ষে ছিল ভারত।

যদিও শেষ পর্যন্ত ইরানকে যে সদস্যপদ দেওয়া হলো - তাতে অর্থনীতির চেয়ে রাজনীতিই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

“জোটের সদস্যদের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছে তাতে তারা এটিকে ঠিক মার্কিন বিরোধীজোট হিসেবে প্রতিভাত করতে চাননি। ভারত মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশগুলোকে নিতে চায়নি। কিন্তু ইরানকে সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে। তাই বলা যায় একটি মাপকাঠি করা হলেও তাতেও সম্ভবত সব দেশ একমত হতে পারেনি,” বলছিলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

গত ২২শে অগাস্ট শুরু হওয়া ব্রিকসের সম্মেলন শেষ হয় ২৪শে অগাস্ট

তবে ব্রিকস নেতারা যেটি দেখাতে চাইছেন তা হলো বিশ্ব বাণিজ্য ও উৎপাদনের বড় অংশই তাদের করায়ত্ত এবং এ কারণেই তুলনামূলক বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশগুলোকে এবার প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, “তারা বৈশ্বিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও জিডিপি – ২৫ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। বিকল্প অর্থব্যবস্থা করতে হলে এটি গুরুত্বপূর্ণ। আর বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে জ্বালানি অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো।’

সৌদি আরব কেন?

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ব্রিকসের নতুন ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রফতানিকারক দেশ সৌদি আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক দেশ চীনের সঙ্গে একই অর্থনৈতিক জোটে যোগ দিল।’

এর আরেকটি অর্থ হচ্ছে, তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক-এর সদস্য রাশিয়া ও সৌদি আরব একে অপরের সঙ্গে আরও একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্লকে অংশ নিতে যাচ্ছে।

এই দু’টি দেশ প্রায়শই তেল উৎপাদন কার্যক্রম নিয়ে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে, যা নিয়ে অতীতে অনেক সময় সৌদি আরবকে তার আরেক মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিব্রতও হতে হয়েছে।

আরব আমিরাত

অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে বর্ধিষ্ণু বড় অর্থনীতি আর জ্বালানি অর্থনীতি- এ দু’টি বিষয়ের বিবেচনা থেকেই আরব আমিরাতকে সদস্যপদ দিচ্ছে ব্রিকস।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির অর্থনীতি ব্যাপকভাবে বিকশিত হচ্ছে এবং দেশটি এখন বিশ্বে বিনিয়োগের আকর্ষণীয় জায়গাগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে।

ইরান

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানকে সদস্যপদ দেওয়া হবে কিনা এ নিয়ে ব্রিকস সদস্যদের মধ্যে মতভেদ ছিল। বিশেষ করে ভারত চেয়েছিল সরাসরি নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশগুলোকে আপাতত না নেওয়া হোক।

কিন্তু ইরানের বিষয়ে চীনের চাপ ছিল এবং আগ্রহ ছিল রাশিয়ারও। সে কারণেই শেষ পর্যন্ত নমনীয় হতে হয়েছে ভারতকে।

এছাড়া জ্বালানি অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গিও ইরানের সদস্যপদ প্রাপ্তির পক্ষেই কাজ করেছে। বলা হয় মধ্যপ্রাচ্যের তেলের এক-চতুর্থাংশই এ দেশটিতে সংরক্ষিত আছে।

নতুন ছয় দেশসহ সব সদস্য দেশের নেতাদের দেখা যাচ্ছে।

আর্জেন্টিনা

অনেকদিন ধরেই দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে আসছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টারের ব্লগে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জর্জ হেইনে লিখেছেন যে আমেরিকা ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক আছে আর্জেন্টিনার। ব্রিকসের সদস্যপদ লাভের মধ্য দিয়ে নিজেকে একধাপ এগিয়ে নিল দেশটি।

আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। দেশটি নিজে থেকেই ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহী ছিল। দেশটি অর্থনৈতিক ও সার্বভৌম ঋণ সংকটের মধ্যে আছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও তলানিতে।

তবে ব্রিকস সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এর অর্থনীতির আকারকেই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

মিসর ও ইথিওপিয়া কেন?

এ দু’টি দেশকে কোন বিবেচনায় ব্রিকসের সদস্যপদের জন্য মনোনীত করা হয়েছে তার ঠিক সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

যদিও ইথিওপিয়া আফ্রিকার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। মাথাপিছু আয় অনেক কম হলেও দেশটির অর্থনীতির আকার ও সম্ভাবনা বিবেচনা নিয়েই সদস্য পদ দেওয়ার সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

অন্যদিকে মিসর আগেই ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে যোগ দিয়েছিল। দেশটি আঞ্চলিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থনীতিও শক্তিশালী।

তবে ব্রিকসের সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেশটির অর্থনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতিও হয়তো ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

সূত্র : বিবিসি

এমইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর