শতাব্দীকালের সাক্ষী তিনি। আগের মতো দুর্দান্ত প্রতাপ নেই শরীরে। এই বয়সে এসেও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তৎপর সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। সম্প্রতি তার চীন সফরে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়েছে। আর কিসিঞ্জারকে ‘পুরোনো বন্ধু’ উল্লেখ করে অভিনন্দন জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন কিসিঞ্জার। তার এই সফরকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক উন্নয়নে চলমান কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ মনে করা হচ্ছে। মানবাধিকার, বাণিজ্য, জাতীয় নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে দূরত্ব আরও বেড়েছে দুই দেশের। ওয়াশিংটন-বেইজিংয়ের শীতল সম্পর্ক উষ্ণ করতে কিসিঞ্জার কাজ করছেন বলে ধারণা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের।
বিজ্ঞাপন
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে চীনের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায়। একের পর এক পণ্যে পাল্টাপাল্টি করারোপ, একে অপরের প্রতি সন্দেহ বাড়ে প্রবলভাবে। যা দুই দেশের অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এমন অবস্থায় বর্তমান বাইডেন প্রশাসন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা সম্প্রতি একের পর পর চীন সফর করেছেন। তারই মধ্যে হঠাৎ করে পূর্ব কোন ঘোষণা ছাড়া বেইজিং সফর করলেন ১০০ বছর বয়সি সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার।
যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য কিসিঞ্জারের সফরকে সরকারিভাবে হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেনি। তারা বলছে, কিসিঞ্জার একজন বেসরকারি আমেরিকান নাগরিক হিসাবে চীন সফরে গেছেন।
বিজ্ঞাপন
বিবিসির সাংবাদিক টেসা ওয়াং বলছেন, ১৯৭০ এর দশকে চীন যখন কূটনৈতিকভাবে একঘরে হয়েছিল তখন দেশটিকে সেই অবস্থা থেকে বের করে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। অন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে কিসিঞ্জারের যে বিশাল ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে, তাতে মনে হয় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে আলোচনায় তিনি পেছনের দরজা দিয়ে প্রভাব খাটানোর কাজ করতে পারেন।
কিসিঞ্জারকে ঘনিষ্ঠভাবেই বরণ করেছে চীন। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাকে বেইজিংয়ের দিয়াওউতাই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে স্বাগত জানান। সাধারণত বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে গ্রেট হল অফ দ্য পিপলে বৈঠক করেন শি। তবে কিসিঞ্জারের ক্ষেত্রে এটি ব্যতিক্রম। দিয়াওউতাই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন অনেকটা শির একান্ত বৈঠকস্থল।
বৈঠকের সময় চীনা প্রেসিডেন্ট ইতিহাসের কথা স্মরণ করে বলেন, এই দিয়াওউতাই রাষ্ট্রীয় অতিথিভবনেই ৫০ বছর আগে চীন-মার্কিন সম্পর্ক স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে গোপনে এক বৈঠক করেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। আমরা কখনই পুরনো বন্ধুদের ভুলি না এবং চীন মার্কিন সম্পর্ক উন্নয়নে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে আপনার ঐতিহাসিক অবদান আমরা কখনই ভুলব না।
সোমবার কিসিঞ্জার চীনে অবতরণ করেন। তিনি শীর্ষ চীনা কূটনীতিক ওয়াং ই এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লি শাংফুর সঙ্গেও দেখা করেন, যিনি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছেন। তাদের বৈঠকগুলো নিয়ে চীনা বিবৃতিতে আপোষের পরিষ্কার সুর দেখা গেছে। যদিও বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
বৈঠক পরবর্তী এক বিবৃতিতে কিসিঞ্জারকে কিংবদন্তী কূটনীতিক বলে উল্লেখ করেছে চীন। এছাড়াও তার পূর্বের কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করা হয়।
কিসিঞ্জারের কথা তুলে ধরে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তিনি চীনের বন্ধু। কিসিঞ্জার বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন করোরই পরস্পরকে প্রতিপক্ষ হিসাবে গণ্য করা ঠিক হবে না। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রে রয়েছে এই দুই দেশের সম্পর্ক এবং আমাদের সমাজের অগ্রগতির জন্যও তা গুরুত্বপূর্ণ।
শি সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ছাড়া সফর করা অন্য কোনো শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিসিঞ্জার।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে ভূমিকার কারণে এশিয়ার অন্যান্য দেশে কিসিঞ্জার বিতর্কিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে চীনকে বের হতে সহায়তা করার জন্য চীনে তার বিরাট কদর রয়েছে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ১৯৭১ সালে সরকারিভাবে কোন কূটনৈতিক যোগাযোগ যখন ছিল না, তখন কিসিঞ্জার গোপনে বেইজিং সফরে যান তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চীন সফরের ব্যবস্থা করার লক্ষ্য নিয়ে।
পরের বছর নিক্সন চীনের মাটিতে নামেন এবং মাও সেতুংসহ চীনের শীর্ষ নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়।
যুক্তরাষ্ট্র যতই কিসিঞ্জারের সফরকে ব্যক্তিগত হিসেবে উল্লেখ করুন, বিশ্লেষকরা সেটি মানতে নারাজ। তাদের মতে, শতবর্ষী হয়েও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতির ভূমিকা পালন করছেন কিসিঞ্জার। দুই দেশের সম্পর্কের সংকটকালে আবারও ত্রাতা হয়ে দেখি দিয়েছেন তিনি।
একে