জার্মানিতে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য বরাদ্দ করা অন্তত ১৩০টি আশ্রয়কেন্দ্র সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়৷ জার্মান পাবলিক ব্রডকাস্টার এবং সংবাদপত্র জ্যুডডয়চে সাইটুং-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে এ খাতে যুক্ত ব্যবসায়ীরা মোটা অংকের মুনাফা গুনছে৷ খবর ইনফো মাইগ্রেন্টসের।
সারকো একটি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান৷ ইউরোপের দেশ, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার সরকারের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে প্রতিরক্ষা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ, কারাগার এবং অভিবাসনের মতো খাতগুলোতে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি৷
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: দক্ষ কর্মীদের ভিসা দিচ্ছে জার্মানি
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারকো এবং তার সহযোগী সংস্থাগুলো জার্মানির অভিবাসন খাতে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছে৷ জার্মান সংবাদপত্র জ্যুডডয়চে সাইটুং-এর সঙ্গে সমন্বয়ে করা দেশটির পাবলিক ব্রডকাস্টার এআরডি এবং জেডডিএফ-এর গবেষণা বলছে, জার্মানিতে আশ্রয়প্রার্থীদের অন্তত ১৩০টি কেন্দ্র সারকোর সহযোগী সংস্থা ওআরএস এবং ইউরোপিয়ান হোমকেয়ার দেখভাল করছে৷ এসব আশ্রয়কেন্দ্রে অন্তত ৫৫ হাজার আশ্রয়প্রার্থী রয়েছেন৷
কয়েক বছর ধরে যুক্তরাজ্যে এই ধরনের ব্যবসা করে আসছে সারকো৷ জ্যুডডয়চে সাইটুং বলছে, ব্রিটেনের সঙ্গে কোম্পানিটির দশ বছরের চুক্তি রয়েছে, যা অন্তত ২০২৯ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে৷ এর পরিমাণ প্রায় দুইশ কোটি পাউন্ড৷ ২০১৪ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়াতে অভিবাসন আটককেন্দ্রও পরিচালনা করছে সারকো৷ দশ বছরের মেয়াদি এই চুক্তির আর্থিক মূল্য প্রায় চারশ কোটি অস্ট্রেলিয়ান ডলার৷ চলতি বছর অবশ্য সারকো জানিয়েছে, চুক্তির মেয়াদ আর বাড়বে না৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির ১৩টি রাজ্যে আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান
ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ায় এই ব্যবসার পরিচালনা পদ্ধতির নানা দিক নিয়ে সমালোচনা করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো৷ জ্যুডডয়চে সাইটুং বলছে, নিম্নমানের খাবার, হাতকড়া পরিয়ে বন্দি পরিবহণ, আত্মহত্যার ঘটনা এবং বিচ্ছিন্ন সেল তৈরির মতো অভিযোগ রয়েছে সারকোর বিরুদ্ধে৷
এখন জার্মানির ১৩টি রাজ্যে অনেক আশ্রয়কেন্দ্র চালানোর চুক্তি করেছে বেসরকারি সংস্থা৷ জার্মানিসহ ইউরোপজুড়ে এই প্রবণতা আরো বাড়ছে৷ আগে এসব চুক্তিগুলো হতো রাষ্ট্রীয় সংস্থা, দাতব্য সংস্থা বা সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলোর সঙ্গে৷ কিন্তু আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য সরকারগুলোর আর্থিক বরাদ্দ কমতে থাকায় এখন বেসরকারি সংস্থাগুলো এসব চুক্তি করার সুযোগ পাচ্ছে৷ কারণ, আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনায় যে প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন খরচ দেখাতে পারে, তাদের সঙ্গে এসব চুক্তিগুলো করা হয়৷
ইউনিভার্সিটি অব ডুইসবুর্গ-এসেন এর অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক ভের্নার নিনহ্যুজার এআরডিকে বলেন, আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করে ‘সারকো আগে যা আয় করতো, এখন তাদের মুনাফা আরো অনেক বেড়েছে৷ তাই মনে হচ্ছে, তারা এমন একটি খাত বেছে নিয়েছে যেখানে তারা সত্যিই মুনাফা অর্জন করতে পারে৷’
আরও পড়ুন: যুক্তরাজ্যে গৃহহীন অভিবাসীর সংখ্যা বেড়েছে
তদন্ত দলগুলো এ সংক্রান্ত কিছু গোপনীয় নথি দেখার সুযোগ পেয়েছে৷ সেখানে দেখা গেছে, সারকোর সহাযোগী সংস্থাগুলো কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করতে গিয়ে ৫০ শতাংশের বেশি লাভ করেছে৷ গত বছর রাইনলান্ড-পালাটিনেটের হান বিমানবন্দরের কাছের একটি আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করে লাভ করেছে ৬৬.৮ শতাংশ৷
জার্মানিতে আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি লাভ নিয়ে জানতে চাওয়া হলেও সরাসরি কোনো উত্তর দেয়নি ওআরএস৷ এআরডিকে সংস্থাটি বলেছে, ২০২৩ সালে ইউরোপজুড়ে অভিবাসন খাতে আমাদের নিট মুনাফা একক সংখ্যায় (সিঙ্গেল ডিজিট) ছিল৷ সারকোর এই সহযোগী প্রতিষ্ঠানটি ইটালি, স্পেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ডেও অভিবাসন কেন্দ্র পরিচালনা করে৷
অর্থই প্রধান লক্ষ্য
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওআরএস এর সাবেক এক কর্মী বলেন, ‘=অর্থ, অর্থ, অর্থ, এটাই মূল লক্ষ্য৷ ব্যবসাটি লাভজনক হতেই হবে৷’ অন্য একজন বলেছেন, ‘লক্ষ্য হলো আশ্রয়প্রার্থীদের ঠকিয়ে ধনী হওয়া৷ তাদের প্রকৃতপক্ষে মানুষ হিসাবে দেখা হয় না, কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করার পণ্য হিসাবে দেখা হয়৷’
অতি মুনাফার আশায় তারা সবকিছু সর্বনিম্ন মানের করে বলে অভিযোগ এনেছেন সমালোচক এবং সাবেক কর্মীরা৷
ওআরএস-এর সাবেক এক কর্মী যে কেন্দ্রটিতে কাজ করতেন সেখানকার খাবার প্রসঙ্গে একটা গল্প শুনিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি, আমরা তাদের এই ধরনের খাবার দিতে পারি না৷ এগুলোর মানুষের খাবার নয়, এগুলো প্রাণীদের খাবার৷’’ উত্তরে তাকে বলা হয়েছিল, আশ্রয়প্রার্থীরা ‘‘এসব খেয়ে অভ্যস্ত হয়ে যাবে৷’
বিপুল অর্থ
বিশ্বজুড়ে সারকোর টার্নওভার প্রায় পাঁচশ কোটি পাউন্ড৷ যদিও এর ৩৫ শতাংশ আসে প্রতিরক্ষা খাত থেকে৷ তবে, অভিবাসন দিন দিন আরো লাভজনক হয়ে উঠছে৷ গত বছর ব্রিটেনের সংবাদপত্র দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, সারকো চার কোটি ইউরোর বিনিময়ে জার্মানিতে আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনাকারী সহায়ক সংস্থা ইউরোপিয়ান হোমকেয়ারকে নিজেদের অধীনে নিয়েছে৷ জুনে বলা হয়েছে, এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে৷
২০২৩ সালের নভেম্বরে গিনি থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থী মামাদো ডায়ালো আশ্রয়কেন্দ্রে মারা গেলে সমালোচনার মুখে পড়ে সারকো৷ কারণ, বার্লিনের দক্ষিণ-পশ্চিমে সারকো পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্র থাকতেন গিনির ওই আশ্রয়প্রার্থী৷
তার মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি৷ কিন্তু সংবাদপত্রগুলোতে বলা হয়েছে, তার মৃত্যুর খবরটি জানা গেছে মৃত্যুর অন্তত চার সপ্তাহ পর৷ তার ঘর থেকে তীব্র কটু গন্ধ ছড়ানোর পর অন্য আশ্রয়প্রার্থীরা তার মৃত্যুর খবর জানতে পারেন৷
চুক্তি বাতিল করেছে বার্লিন
এ ঘটনার পর ওআরএস-এর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে বার্লিন৷ বার্লিনের শরণার্থী ও আশ্রয়বিষয়ক অফিস জানিয়েছে, ‘গুরুতর ত্রুটি’ এবং ‘একাধিক কাঠামোগত সমস্যার’ কারণে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে৷ তদন্ত চলমান থাকায় এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি তারা৷
অভিযোগ ভিত্তিহীন বলছে ওআরএস৷ তাদের দাবি, ‘আমরা আমাদের দায়িত্বগুলো খুব গুরুত্বের সঙ্গে পালন করি এবং ঠিকাদার হিসাবে আমরা আমাদের উচ্চমান নিশ্চিত করি৷’
অধিকারকর্মীদের শঙ্কা
গত বছর সমাজকল্যাণ সম্পর্কিত চারটি সংস্থা বার্লিনের শরণার্থী ও আশ্রয় বিষয়ক দপ্তরে সারকোর বিরুদ্ধে চিঠি দিয়েছে৷ তারা বলেছে, সারকো আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ায় তারা বেশ চিন্তিত৷ কারণ তারা শঙ্কা করছেন, আশ্রয়প্রার্থীদের কল্যাণের চেয়ে মুনাফা অর্জন সারকোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ৷
তথ্যসূত্র: ইনফো মাইগ্রেন্টস
এজেড