রাজধানীর পাশ্ববর্তী টঙ্গীর বাসিন্দা মো. বক্স উল্লাহ। চলিশোর্ধ্ব এই ব্যক্তি এখন পর্যন্ত ৭১ বার রক্তদান করেছেন। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) নিজের বড় ভাইকে রক্ত দেন তিনি। রক্তদানের বিষয়ে বক্স উল্লাহ বলেন, এটি আমার ৭১তম রক্তদান। চার মাস পরপর রক্ত দেই। একবার তিন মাসের আগেও রক্ত দিয়েছিলাম। আমার বাসার পাশের মসজিদের ইমামের ছেলে দুর্ঘটনায় আহত হলে জরুরি রক্তের প্রয়োজন ছিল। অন্য ডোনার না থাকায় নিজেই রক্ত দিয়েছিলাম। ওই একবার ছাড়া কখনও সামান্য মাথাও ঘোরায়নি। বরং রক্ত দিয়ে শারীরিক ও মানসিক স্বস্তি পাই।
বক্স উল্লাহর মতো দেশে অসংখ্য তরুণ ও স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি রক্তদান করছেন। এদেরকে আমরা ‘স্বেচ্ছায় রক্তদাতা’ জানলেও তারা আসলে রিপ্লেসমেন্ট বা রিলেটিভ ডোনার। অর্থাৎ তারা নিজের স্বজন কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রক্তের চাহিদা অনুযায়ী পরিচিত বা পরিচিত কারোর মাধ্যমে রক্ত দিচ্ছেন। যদিও রক্ত গ্রহণের জন্য রোগীর স্বজনদের ডোনার খোঁজার কথা ছিল না। ভর্তি হওয়া হাসপাতাল কিংবা নির্দিষ্ট ব্লাড ব্যাংক থেকেই তাদের রক্ত পাওয়ার কথা। তার পরিবর্তে স্বজন কিংবা পরিচিত ব্যক্তিসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রক্ত খুঁজতে হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে ব্লাড ব্যাংক বা হাসপাতালগুলোর প্রতি আস্থাহীনতাকে দায়ী মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন অ্যান্ড থেলাসেমিয়া ম্যানেজমেমেন্ট শাখা থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, সারাদেশে ২০৬টি সরকারি এবং ১৭২টি বেসরকারি ব্লাড ব্যাংক বা রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রে নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন করা হয়। গত চার বছরে এসব (৩৭৮টি) রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রে (ব্লাড ব্যাংক) ৩৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬১৮ জন ‘স্বেচ্ছায় রক্তদাতা’র রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয়েছে। এদের বেশিরভাগই রিপ্লেসমেন্ট বা রিলেটিভ ডোনার।
দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার হার মাত্র ৩১ শতাংশ। প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ১৪ লাখ ইউনিট রক্তের প্রয়োজন। বিশ্বের প্রায় ৬২টি দেশে শতভাগ স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। উন্নত বিশ্বে স্বেচ্ছায় রক্তদানের হার প্রতি এক হাজারে ৪৫ জন। অন্যদিকে বাংলাদেশ তথা উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রতি হাজারে ৪ জনেরও কম। বাংলাদেশে ঘাটতি পূরণ ও অনিরাপদ রক্তের ব্যবহার বন্ধ করতে বর্তমানের চেয়ে বছরে মাত্র ৫ লাখ ব্যাগ অতিরিক্ত সংগ্রহ করতে হবে।
অধিদফতরের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির মাধ্যমে বিভাগ ও জেলা ও ইউএইচসি তথা উপজেলা হেলথ কেয়ারের তত্ত্বাবধানে ২০৬টি সরকারি ব্লাড ব্যংক রয়েছে। এছাড়া সরকারি হাসপাতালের বাইরে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, কেয়ান্টাম, সন্ধানী, বাঁধন, থেলাসেমিয়া ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ থেলাসেমিয়া সমিতি অনুমোদিত ১৭২টি বৈধ বেসরকারি ব্লাড ব্যাংক রয়েছে। এর বাইরেও সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা অসংখ্য অনিবন্ধিত ব্লাড ব্যাংক ও প্লাজমা সেন্টার আছে। এসব জায়গা থেকে রক্ত নেওয়া নিরাপদ নয়। তারা অসহায় রোগীদের ফাঁদে ফেলে ‘লাল রক্তের কালো ব্যবসা’ করছে। যা স্বেচ্ছায় রক্তদানের পথে অন্যতম অন্তরায়। এ ধরনের ব্যবসার কারণেই রক্তদাতারা স্বেচ্ছায় রক্তদানের বিপরীতে সরাসরি ডোনারকে রক্ত দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।
বিজ্ঞাপন
প্রয়োজন সচেতনতা ও আস্থার পরিবেশ
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ব্লাড সেন্টারের মেডিকেল অফিসার ডা. জাহিদুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, গত বছরে সারাদেশে রক্তের মোট চাহিদার শতকরা ১১ শতাংশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সরবরাহ করেছে। সারাদেশে সোসাইটির ৮টি রক্ত কেন্দ্র রয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে রক্তদাতাদের মোটিভেশন, সংগ্রহ, স্ক্রিনিং, সংরক্ষণ ও বণ্টন করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন কলেজ, কল-কারখানা ও জাতীয় অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছায় দাতাদের থেকে এসব রক্ত সংগ্রহ করা হয়। অনেকে সেন্টারগুলোতে এসে রক্তদান করেন। এর বাইরেও রেড ক্রিসেন্টের যুব স্বেচ্ছাসেবকরা প্রয়োজন অনুযায়ী ‘অন কলে’ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সরাসরি ডোনার হিসেবে রক্ত দিয়ে আসেন। তবে এটি ১১ শতাংশের অন্তর্ভুক্ত না।
দেশে রক্তাদনের বেশিরভাগ রিপ্লেসমেন্ট ডোনার থেকে আসে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশে একটা বড় অংশ স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন না। সাধারণত চিকিৎসকের চাহিদা অনুযায়ী বন্ধুবান্ধব বা কারোর মাধ্যমে রিপ্লেসমেন্ট ডোনার হিসেবে দেশে রক্তদান হয়। স্বেচ্ছায় রক্তদানের কালচার বাংলাদেশে গড়ে উঠেনি। এটি না হলে কখনোই কোয়ালিটি রক্ত সরবরাহ ও রক্তের চাহিদা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
রেডক্রস ও ক্রিসেন্ট সোসাইটি বিশ্বের ৬৮টি দেশে রক্ত সাপ্লাই চেইন নিয়ন্ত্রণ করে। হাসপাতালে চাহিদা অনুযায়ী সংগঠনটি রক্তের যোগান দেয়। ফলে স্বজনদেরকে রক্ত খুঁজতে হয় না।
বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি গড়ে না উঠার কারণ হিসেবে ব্যবসায়িক মনোভাব, সচেতনতার ঘটতি ও আস্থার সংকট দায়ী বলে মনে করেন ডা. জাহিদুর রহমান। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সেন্টার থেকে যেকোনো ব্লাড গ্রুপের রক্ত স্ক্রিনিং ও ব্যাগের সমঅর্থ পরিশোধ করে সরবরাহ করা হয়। অথচ অনেক অবৈধ ব্লাড ব্যংক নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত ১০ থেকে ১৫ হাজার বা তারও অধিক দামে বিক্রি করেন। স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে কেউ চায় না তার রক্ত দিয়ে ব্যবসা হোক। এটি স্বেচ্ছায় রক্তদানের অন্যতম অন্তরায়। তাই সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি আস্থার পরিবেশ তৈরি জরুরি।
বাংলাদেশে রক্তদানের অন্যতম বিশ্বস্ত সংগঠন সন্ধানী। তাদের কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠটির ঢাকা মেডিকেল ইউনিটের সভাপতি মোস্তফা আহমেদ সুমন ঢাকা মেইলকে বলেন, সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদের অধীনে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১৩৪টি ইউনিট রয়েছে। এসব ইউনিট বিভিন্ন সময় ব্লাড ক্যাম্পের মাধ্যমে এবং জাতীয় দিবসসহ নানা কর্মসূচি থেকেও রক্ত সংগ্রহ করে। মেডিকেলে শিক্ষার্থীরা এতে সংক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। পরবর্তীতে সন্ধানী শুধুমাত্র স্ক্রিনিং ও ব্যাগের খরচ রেখে চাহিদা অনুযায়ী রক্ত সরবরাহ করে। সাধারণ সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যান্ত অফিস টাইমে সন্ধানী রক্ত সরবরাহ করে। তবে কেউ যোগাযোগ করলে অফিস সময়ের বাইরেও রক্ত সরবরাহ করা হয়। শুধুমাত্র ঢাকা মেডিকেলেই প্রতিদিন ১০-১২ জন রোগীকে সংগঠনটি রক্ত সরবরাহ করে।
তবে অনেক ব্লাড ব্যাংক ব্যবসায়িক মনোভাব ও কর্মীদের বেতনের বিষয় থাকায় বেশি অর্থ রাখেন। সন্ধানী একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হওয়ায় তাদের এ ধরনের কোনো বিষয় নেই বলেও জানান সন্ধানী ঢামেক ইউনিটের সভাপতি।
এমএইচ