শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বরাদ্দ ব্যবহারের ‘অক্ষমতায়’ বাড়ছে না স্বাস্থ্য বাজেট

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ৩০ মে ২০২৩, ০৭:৪৭ পিএম

শেয়ার করুন:

বরাদ্দ ব্যবহারের ‘অক্ষমতায়’ বাড়ছে না স্বাস্থ্য বাজেট

একটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেবা খাত হলো স্বাস্থ্য। অথচ বাংলাদেশে এ খাত সর্বদাই অবহেলিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে করোনা মহামারিসহ নানা পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার এ খাতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। তারপরও তা পর্যাপ্ত নয়। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার জন্য বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, একটি দেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ এবং বাজেটের ১৫ শতাংশ হওয়ার কথা। অথচ চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) জাতীয় বাজেটের শতকরা ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ ছিল স্বাস্থ্য খাতে। যা দেশের মোট জিডিপির শতকরা ১ শতাংশেরও কম। আর মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় মাত্র ১১০ ডলার।

এ বাস্তবতায় দীর্ঘদিন ধরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও খাত সংশ্লিষ্টরা। যদিও এতে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। উল্টো বরাদ্দ কোভিডকালে কিছুটা বাড়লেও বর্তমানে কমে আসছে। যেমন ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেটে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ চলতি বছরের তুলনায় কমে যাওয়ার আভাস পাওয়া গেছে।


বিজ্ঞাপন


এদিকে বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে। গত ৫ বছরের বাজেট বরাদ্দ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কোনো বছরই মন্ত্রণালয়টি তার বরাদ্দের পূর্ণ ব্যবহার করতে পারেনি। ফলে অব্যবহৃত বরাদ্দ অর্থ বিভাগে ফেরত যাচ্ছে, যা পরবর্তী বরাদ্দের সময় নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অডিট বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থ বছরের প্রথম ১০ মাসে বাজেটে মোট বরাদ্দের মাত্র ৩৩ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। অর্থাৎ বরাদ্দের ৬৭ শতাংশ এখনও অব্যবহৃত রয়েছে। যদিও বছর শেষে ব্যবহারের হার বাড়বে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ হিসেবে এর মাঝে হওয়া টেন্ডারের হিসাব না আসাসহ একাধিক বিষয়ের কথা বলছেন তারা।

Budgetযদিও শুধু চলতি অর্থ বছরই নয়, প্রতিবছরই বরাদ্দ ফেরত যাওয়া যেন স্বাস্থ্য বিভাগের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৯ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরের ৪২ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৬ দশমিক ০৪ শতাংশ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১১ দশমিক ২২ শতাংশ বরাদ্দ ফেরত গিয়েছিল।

এ অবস্থায় স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে ও মানুষের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি তা ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব বরাদ্দের অর্থ ব্যবহার নিশ্চিতে সঠিক পরিকল্পনা ও দক্ষতা বাড়ানো বিকল্প নেই।


বিজ্ঞাপন


এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানো উচিত। এটি যেমন সত্য, তার চেয়েও বেশি সত্য টাকাটা যেন যথাযথভাবে ব্যবহার হয় তা নিশ্চিত করা। প্রতিবছরই আমরা শুনি, বাজেটে বরাদ্দের টাকা ফেরত যায়। তাই বাজেট বাড়ানোর পাশাপাশি বরাদ্দের টাকায় যেন দুর্নীতি না হয় এবং তা যেন ব্যবহার না হয়ে ফেরত না যায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যদি টাকা ফেরতই যায় তাহলে বাড়িয়ে লাভ কি? স্বাস্থ্য খাতে যদি জনগণের সুবিধা বিবেচনা করে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী টাকা ব্যবহার করা না যায় তাহলে বাজেট বাড়ানোর দাবিটা দুর্বল হয়ে যায়।

সমস্যা সমাধানের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি সমাধানে যারা স্বাস্থ্যের প্রশাসনিক দায়িত্বে রয়েছেন তাদের যত্নশীল হতে হবে। আমি স্বাস্থ্য প্রশাসনের লোক নই। ফলে কেন তারা ব্যর্থ হচ্ছে সেটি সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারব না। তবে স্বাস্থ্য খাতের মানুষ হিসেবে এর জন্য দায়িত্বশীলদের অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও সমন্বয়হীনতাকে দায়ী মনে করি। এসব বিষয়ে তাদের নজর দিতে হবে।

Budgetএসব বিষয় নিয়ে ঢাকা মেইলের সাথে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি স্বাস্থ্য বাজেটের নানাদিক নিয়ে তার ব্যাখ্যা তুলে ধরেন।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৬৭ শতাংশ অব্যবহৃত থাকা প্রসঙ্গে বলেন, সব বাজেটের দুইটি অংশ থাকে। একটি অপারেটিং বা পরিচালন বাজেট এবং অপরটি ডেভলপমেন্ট বা উন্নয়ন বাজেট। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে অনেক বেশি অব্যবহৃত দেখা যাচ্ছে। তবে চলতি মে ও জুনের ১৫ তারিখের মধ্যে এটি ৭০ থেকে ৮০-৮৫ শতাংশে চলে যাবে। এর ব্যাখ্যা রয়েছে সরকার যে পদ্ধতিতে টাকা ছাড় দেয় তার মধ্যে। প্রথম দুই কিস্তির টাকা সরকার অর্থবছরের শুরুতেই ছাড় দেয়। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয়ের অর্থও রয়েছে। আর উন্নয়ন তথা কেনাকাটার ক্ষেত্রে প্রথম দুই কিস্তি আগে দেয়। এরপর দেখে কেনাকাটার অগ্রগতি কতদূর। সেই বিবেচনায় পরের দুই কিস্তির টাকা ছাড় দেয়। এখানে সরকারের নিয়মিত টাকা ফ্লোয়ের বিষয়ও থাকে।

এসব কেনাকাটার ক্ষেত্রে অনুমোদন নিতে হয়। এই অনুমোদনগুলো দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। বিল পাস করাতে অনেকটা সময় চলে যায়। ফলে মে বা জুন মাসে যে খরচ দেখব তার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে। কারণ টেন্ডার ডাকা, ফরম জমা নেওয়া, টিকাদার নির্বাচন করা, তাদের টাকা দেওয়া, সর্বশেষ তাদের হিসেব মিলিয়ে চেক দেওয়ার বিষয় রয়েছে। যা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এই জন্য আমরা শুরুতে খরচ কম দেখতে পাই। আর শেষের দিকে এসে অর্থ ব্যবহারের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। তবে মে ও জুনে কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের নামেও অর্থ ব্যয় করা হয়। যার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, বলছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ।

>> আরও পড়ুন: করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকায় নির্ধারণের দাবি

বাজেট বরাদ্দ ফেরত যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি একক কোনো সমস্যা না বরং একাধিক সমস্যার মিশ্রণ। স্বাস্থ্য খাতে আমরা এখনও সিস্টেম ডেভেলপ করতে পারিনি। এ খাতটি অবহেলিত। এটি দালালদের দখলে। যারা স্বাস্থ্য বুঝে না, এই খাতের গুরুত্বও বুঝে না। এই খাতের প্রাণ চিকিৎসকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। তাদেরকে আমরা ব্যবস্থাপক হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি। তাদের যে কর্ম পরিবেশ দেওয়া উচিত ছিল তা দিতে পারিনি। ফলে এ খাতে অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা রয়ে গেছে। যার ফল আমরা বাজেট ব্যবহারে দেখতে পাই।

সমস্যা সমাধানে খাত সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্য প্রশাসনে আসতে হবে জানিয়ে অধ্যাপক আব্দুল হামিদ বলেন, চিকিৎসকরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমাদের দেশের সবচেয়ে মেধাবী মানুষগুলো ওই পেশায় যায়। কিন্তু আমরা তাদের দমিয়ে রেখেছি। ফলে তাদের থেকে আমরা সার্ভিস পাচ্ছি না। এখানে হাত দিতে হবে। সচিবালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্ব চিকিৎসকদের দিয়ে দিতে হবে। কারণ তারা জানে স্বাস্থ্যের কোথায় কি সমস্যা রয়েছে। কোথায় কি কাজ করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রশাসন চালানোর মতো চিকিৎসক আমাদের নেই। তারা এখনও প্রস্তুত না। কোনো চিকিৎসককে এই মুহূর্তে সচিবের আসনে বসিয়ে দিলে সে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। এজন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। অন্তত ১০ থেকে ১৫ বছর প্রস্তুতি নিয়ে সচিবালয়ের প্রতিটি কক্ষে খাত সংশ্লিষ্ট লোক দিতে হবে। পৃথিবীর বহুদেশ, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কাতেও এমন ব্যবস্থা রয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতের সামগ্রিক উন্নয়নে এ খাতের সর্বোচ্চ পদ থেকে প্রশাসনিক সব পদে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক প্রয়োজন বলে মত দেন এই প্রখ্যাত স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। অন্যথায় স্বাস্থ্যখাতের বর্তমানে যে চিত্র দেখা যাচ্ছ সামনে তা আরও খারাপ হতে পরে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

এমএইচ/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর