রোববার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ভয়ানক রূপে ডেঙ্গু, বিপদ এড়াতে সতর্কতার তাগিদ

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:১৬ পিএম

শেয়ার করুন:

dengu
ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু, ছাড় পাচ্ছে না শিশুরাও। ছবি- ঢাকা মেইল

সারাদেশে বিস্তার বেড়েছে এডিস মশার। ক্ষুদ্র এই প্রাণীর কামড়ে ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে ডেঙ্গু। রোগটিতে ভুগে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা চলতি বছরে সর্বোচ্চ। এছাড়া ভয় ধরাচ্ছে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যাও। 

এদিকে ধরণ পাল্টে ফেলেছে ডেঙ্গু। হঠাৎই গুরুতর হয়ে উঠছে রোগীর অবস্থা। প্রথম অবস্থাতেই অনেককে নিতে হচ্ছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে বা আইসিইউতে। এই অবস্থাকে জটিল ও নতুন বাস্তবতা হিসেবে উল্লেখ করছেন চিকিৎসকরা। আগের চেয়ে বাড়ছে সংক্রমণের মাত্রাও। 

এই অবস্থায় সতর্কতার তাগিদ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। ডেঙ্গু সম্পর্কে জানতে বলছেন কিছু জরুরি বিষয়। তাতেই এড়ানো যাবে বিপদ। তার মধ্যে রয়েছে রোগটির লক্ষণ, আক্রান্ত হলে কখন হাসপাতালে যাবেন আর কখন বাসায়ই চিকিৎসা নেবেন, খাবারদাবার ইত্যাদি।

M1
ডেঙ্গুর বিস্তারকারী এডিস মশা। ছবি- সংগৃহীত।

যেসব লক্ষণে বুঝবেন ডেঙ্গু হয়েছে


বিজ্ঞাপন


রাজধানীর ফারাজি ডায়গনাস্টিক অ্যান্ড হসপিটালের চিকিৎসক ইব্রাহীম মাসুম বিল্লাহ বলছেন, ‘জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকে। ডেঙ্গু হলে সাধারণত শরীরের তাপমাত্রা ৯৯ থেকে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত ওঠে। শরীরে তীব্র ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, গায়ে র‌্যাশ বা লালচে দানা আসতে পারে।

কখন হাসপাতালে যাবেন আর কখন বাসায় চিকিৎসা নেবেন

এ সম্পর্কে ডা. ইব্রাহীম মাসুম বিল্লাহ বলছেন, ডেঙ্গুর চিকিৎসাকে সাধারণত তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। এ, বি এবং সি। অধিকাংশ রোগী ‘এ’ ক্যাটাগরির। শুধু জ্বর ছাড়া অন্য কোনো লক্ষণ থাকে না। এক্ষেত্রে রোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাসাতেই চিকিৎসা নিতে পারবেন।

‘বি’ ক্যাটগরির ডেঙ্গু রোগীদের কিডনি কিংবা লিভারে সমস্যা, পেট ব্যথা, বমি অথবা অন্তঃসত্ত্বা, অথবা জন্মগত যদি কোনো সমস্যা থাকে, সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, চিকিৎসা করাতে হবে।

‘সি’ ক্যাটগরির ডেঙ্গু জ্বরকে সবচেয়ে খারাপ বলছেন ডা. ইব্রাহীম মাসুম বিল্লাহ। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে রোগীর লিভার, কিডনি বা মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অনেক সময় রোগীর জন্য আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের প্রয়োজন হতে পারে।

M2
একটি হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের পরিস্থিতি। ছবি- সংগৃহীত।

ডেঙ্গু জ্বরে বাড়িতে কী করণীয়, খাবেন কী

ডা. ইব্রাহীম মাসুম বিল্লাহ বলছেন, রোগীকে পরিপূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে। প্রচুর পরিমাণে তরল পানি, লেবুর পানি, ডাবের পানি, ফলের রস অথবা স্যুপ প্রতিদিনই বেশি করে খাওয়াতে হবে। পাশাপাশি ওষুধ হিসেবে প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে। সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কমপক্ষে আটটি প্যারাসিটামল খেতে পারেন।

ডেঙ্গু রোগীর হার্টে, লিভারে বা কিডনিতে কোনো সমস্যা থাকলে তাকে অবশ্যই রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেতে হবে। ডেঙ্গু হলে শরীরের বিভিন্ন অংশের ব্যথা কমানোর জন্য কোনো ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। কারণ, এ জাতীয় ওষুধ শরীরে রক্তক্ষরণ ঘটাতে পারে।

ডেঙ্গু হলে বাসায় যা করা যাবে না

ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে প্লাটিলেট গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তবে বর্তমানে এটি আর মুখ্য নয় বলে জানাচ্ছেন ডা. ইব্রাহীম মাসুম বিল্লাহ। তিনি বলছেন, প্লাটিলেট কমে গেলে বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যদি কোনো কারণে রোগীর প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে নেমে যায় বা রোগীর ব্লেডিং মেনিফেস্টিশন বা কোনো ধরনের রক্তপাত হয়, সেক্ষেত্রে চিকিৎসক চাইলে রোগীকে প্লাটিলেট বা ফ্রেশ ব্লাড দিতে পারেন।

পেঁপে পাতার রস খেলে প্লাটিলেট বাড়ে- এমন একটি কথা প্রচলিত আছে। তবে ডা. ইব্রাহিম মাসুম বিল্লাহ বলছেন, প্লাটিলেট বাড়ানোর জন্য আমরা রোগীকে পেঁপে পাতার রস বা এ জাতীয় কিছু খাওয়ার পরামর্শ দেব না। এতে করে রোগীর কোষ্ঠকাঠিন্যসহ অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিতে পারে।

M3
হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে রোগীদের পরিচর্যা করছেন একজন নার্স। ছবি- সংগৃহীত।

জ্বরের শেষ দিকে করণীয়

এ পর্যায়ে রোগীর দাঁতের মাড়ি, নাক অথবা মলদ্বার দিয়ে রক্তপাত হতে পারে। অথবা রোগীর ব্লাড প্রেসার কমে যেতে পারে। এই অবস্থায় রোগীকে আইবি বা শিরাপথে স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। সেটি অবশ্যই কোনো রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে দিতে হবে।

ডেঙ্গু ছাড়ছে না শিশুদেরও

ডেঙ্গুতে বড়রা তো আক্রান্ত হচ্ছেনই, ছাড় পাচ্ছে না শিশুরাও। তবে ভয়ের ব্যাপার হলো- বড়রা তো নিজেদের খেয়াল রাখতে পারেন, কিন্তু ছোটরা তো পারে না। তাই শিশুদের ডেঙ্গু হলে সেটি বেশি দুশ্চিন্তার বিষয়। এ জন্য শুরু থেকেই সচেতন হতে হবে বড়দের, অর্থাৎ মা-বাবাদের।

এখন প্রশ্ন হলো- অভিভাবকরা সবরকম সতর্কতা অবলম্বন করার পরও ছোট্ট সোনামণিরা যদি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়, তাহলে কী করবেন? 

লক্ষণ চিনে ব্যবস্থা নিন

ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণ হলো হাই ফিভার। এক্ষেত্রে দেহের তাপমাত্রা ১০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে। এছাড়া গায়ে হাত-পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি হয়ে যাওয়ার সমস্যাও পিছু নিতে পারে। কোনো কোনো বাচ্চার ত্বকে লাল লাল ব়্যাশও বেরোতে পারে। সন্তানের দেহে এসব লক্ষণ দেখলেই শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। নইলে অহেতুক সমস্যা বাড়বে।

টেস্ট করতেই হবে

ডেঙ্গু হয়েছে কি না, এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে চাইলে সন্তানের এনএস১ পরীক্ষা করতেই হবে। তবে মুশকিল হলো, জ্বর আসার পাঁচ দিনের মধ্যে এই টেস্ট না করলে রোগ ধরা পড়বে না। তখন আবার করতে হবে আইজিএম টেস্ট।

তাই সন্তানের ভালো চাইলে জ্বর আসার দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই এনএস১ টেস্ট করুন। এতেই দ্রুত রোগ ধরে ফেলা সম্ভব হবে। তারপর শুরু করা যাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা।

M4
হাসপাতালে চিকিৎসারত ডেঙ্গু আক্রান্ত এক শিশু। ছবি- সংগৃহীত।

বাড়িতে রেখে চিকিৎসা সম্ভব?

চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, বেশিরভাগ ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করা হয় এবং তারা একদম সুস্থ হয়ে ওঠে। তাই অহেতুক ভয় পেয়ে লাভ নেই। বরং সন্তানের জ্বর আসার পরপরই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

বাড়িতে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর যত্ন নেবেন যেভাবে

চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুর কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। বরং জ্বর এলে সাধারণ প্যারাসিটামল খেলেই সমস্যা মিটে যাবে। সঙ্গে শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানিপান করাতে হবে। এই দুটি কাজ করতে পারলেই কিন্তু ছোটরা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।

আর অবশ্যই প্রতিদিন নিয়ম করে প্লাটিলেট কাউন্ট এবং পিসিভি টেস্ট করানো দরকার। তাহলেই শিশুর শারীরিক অবস্থার দিকে নজর রাখা সম্ভব হবে। কোনো বেচাল বুঝলে নেওয়া যাবে সঠিক ব্যবস্থা।

কখন হাসপাতালে ভর্তি করা ছাড়া উপায় থাকে না

কয়েকটি ক্ষেত্রে সন্তানকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। যেমন- প্লাটিলেট খুব দ্রুত কমছে, পিসিভি বাড়ছে, সন্তান ঝিমিয়ে পড়ছে, ছোট্ট সোনা খুব কষ্ট পাচ্ছে এবং অকারণে রক্তপাত হচ্ছে ইত্যাদি।

তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডেঙ্গু থেকে ছোটরা দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। তাই অহেতুক চিন্তা করে নিজের রক্তচাপ বাড়ানো বোকামি। বরং সচেতন হয়ে শিশুর যতœ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। 

একইসঙ্গে বাসাবাড়ির আশপাশ অবশ্যই পরিস্কার রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। এছাড়া কোথাও যেন পানি জমতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। তাতে এডিস মশার বিস্তার কমবে। আর দিনে-রাতে ঘুমানোর আগে অবশ্যই মশারি টাঙাতে হবে।

এএইচ      

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর