তামাকের ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণ, তামাকের ভয়াবহতা এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে জনসাধারণকে রক্ষায় তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য ও কর বৃদ্ধির জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছেন দেশের প্রখ্যাত ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ আহছানিয়া মিশন ক্যানসার ও জেনারেল হাসপাতালের ১৫০ জন চিকিৎসক।
বিবৃতি প্রদানকারী উল্লেখযোগ্য ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ হলেন— স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন, বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি হাসপাতাল ও ওয়েলফেয়ার হোমের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ হাই, বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক, আহছানিয়া মিশন ক্যানসার ও জেনারেল হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল অনকোলজির সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এ এম এম শরিফুল আলম, আহছানিয়া মিশন ক্যানসার ও জেনারেল হাসপাতালের মেডিক্যাল অনকোলজির সিনিয়র কনসালটেন্ট অধ্যাপক (ব্রি. জেনারেল) মো. কুদরত-ই-ইলাহী প্রমুখ।
বিজ্ঞাপন
যৌথ বিবৃতিতে ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর প্রধান আটটি কারণের ছয়টির সাথেই তামাক জড়িত। তামাক ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি যেমন ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট ও পায়ে পচন এবং খাদ্যনালীতে ক্যানসারসহ নানা শারীরিক জটিলতা সম্পর্কে এখন আর কারো অজানা নয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স প্রণীত ‘Trend of Tobacco Use in Bangladesh’ ফ্যাক্টশিট অনুসারে গ্যাটস ও স্টেপস, ২০০৯-২০২২ এর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২৫ থেকে ৬৯ বছর বয়সের ৪৭ শতাংশ মানুষ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে থাকে।
গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ধূমপান না করেও প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিভিন্ন পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও পাবলিক পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। আর পরোক্ষ ধূমপান প্রত্যক্ষ ধূমপানের মতোই সমান স্বাস্থ্য ক্ষতিকর। তামাক ব্যবহারের ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, সিওপিডি বা ফুসফুসের ক্যানসার হবার ঝুঁকি ৫৭ শতাংশ এবং অন্যান্য ধরনের ক্যানসার হবার ঝুঁকি ১০৯ শতাংশ বেড়ে যায়। এ কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লক্ষ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে। এমতাবস্থায় তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে তামাকজাত দ্রব্যের উপর কার্যকরভাবে করারোপের মাধ্যমে মূল্য বাড়িয়ে তামাকের ব্যবহার হ্রাসে উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিৎ। এতে করে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত হবে। অন্যদিকে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনেও তা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে (২০২০ থেকে ২০২৪) বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৪৬৮ ডলার বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৭৩৮ ডলার। অথচ এসময়ে বেশিরভাগ সিগারেটের দাম প্রায় অপরিবর্তিত থেকেছে অথবা সামান্য বেড়েছে। ফলে সিগারেটের প্রকৃত মূল্য কমে গেছে। এতে করে সিগারেট অধিক সহজলভ্য হয়ে পড়ছে। তবে আশার কথা, এ বছরের জানুয়ারি মাসে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সিগারেটের সকল স্তরে সম্পূরক শুল্ক ৬৭ শতাংশ করেছে, যা ইতিবাচক পদক্ষেপ। এতদসত্ত্বেও নিম্ন ও মধ্যমস্তরের সিগারেটের মূল্য সহজলভ্যতার মধ্যেই রয়ে গেছে। বর্তমানে প্রতি শলাকা সিগারেটের মূল্য যথাক্রমে ৬ টাকা ও ৮ টাকা। সিগারেটের ব্যবহার কমানোর জন্য এ মূল্যবৃদ্ধি মোটেও সহায়ক নয়। বর্তমান ব্যবহারকারীর ৭৫ শতাংশই নিম্নস্তর সিগারেটের ভোক্তা। এ বিপুল জনগোষ্ঠীকে তামাকের ভয়াবহতা থেকে বাঁচাতে আমাদের প্রস্তাবনা হলো নিম্ন ও মধ্যম —এই ২টি স্তরকে একত্রিত করে প্রতি শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য সর্বনিম্ন ৯ টাকা করা। এটা করা হলে তরুণ ও নিম্ন আয়ের ভোক্তাদের মধ্যে সিগারেটের ব্যবহার কমবে এবং অন্যদিকে রাজস্ব আয় বাড়বে। এই বর্ধিত রাজস্ব চলমান আর্থিক সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। প্রিমিয়াম সিগারেটের ক্ষেত্রে ১০ শলাকা প্রিমিয়াম সিগারেটের মূল্য ১৮৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৯০ টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাবনা আমরা রাখছি।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে, বিড়ির ক্ষেত্রে প্রতিটি বিড়ির মূল্য সর্বনিম্ন ১ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা ৫৫ টাকা, এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ৩০ টাকা নির্ধারণ করে ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাবনা রাখছি। সুপারিশ অনুযায়ী আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকার যদি তামাক পণ্যের বিদ্যমান কর ব্যবস্থা সংস্কার করে, তাহলে সিগারেটের ব্যবহার ১৫.১ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ১৩.০৩ শতাংশ হবে। প্রায় ২৪ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপান থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত হবে এবং প্রায় ১৭ লক্ষ তরুণ ধূমপান শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবে। দীর্ঘমেয়াদে ৮ লক্ষ ৬৪ হাজার ৭৫৮ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৮ লক্ষ ৬৯ হাজার তরুণ জনগোষ্ঠীর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে। প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে অর্থাৎ ২০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় হবে, যা আগের বছরের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি!
তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে করারোপ একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি এবং কার্যকরভাবে কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি করা জরুরি বলে তারা অভিমত দেন। তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে বাস্তবে রূপ দিতে হলে বিদ্যমান তামাকজাত দ্রব্যের কর কাঠামোর সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই বলেও তারা বিবৃতিতে জানান।
এমআইকে/এমএইচটি

