রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা মাহমুদুল হাসান ফয়সাল। সম্প্রতি চোখের সাধারণ চেকআপ করতে যান জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। চেকআপে দৃষ্টিশক্তি বা অন্য কোনো জটিলতা পাওয়া যায়নি। তবে তার চোখ মারাত্মক ড্রাই (শুষ্ক) উল্লেখ করে চিকিৎসক ড্রপ ব্যবহার, স্ক্রিন টাইম কমানোসহ বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।
গণমাধ্যমকর্মী আফজাল হোসেনেরও অভিজ্ঞতাও প্রায় একই। চোখে অস্বস্তির সমস্যা নিয়ে তিনিও গিয়েছিলেন চিকিৎসকের কাছে। চোখে শুষ্কতার (ড্রাই আই) সমস্যা উল্লেখ করে ডাক্তার তাকেও ওষুধ দেন।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা মেইলকে আফজাল বলেন, ‘আমার চোখ খচখচ করছিল। মনে হচ্ছিল চোখের ভেতর সরিষার দানার মতো কোনো ময়লা আছে। চোখ পরিষ্কারের জন্য দুই দিন ক্লিনার ব্যবহার করেও কোনো সুফল পাইনি। পরে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পর তিনি এ সমস্যার কথা বলেন।’
আফজাল হোসেন আরও বলেন, ‘নানা পরিস্থিতিতে কিছুদিন কান্না করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনোভাবেই চোখ থেকে পানি বের হতো না। কিন্তু চোখের সমস্যা ও ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে।’
চোখের ড্রাইনেস বা শুষ্কতা বর্তমানে একটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ১০ থেকে ৩০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এই সমস্যার শিকার। দক্ষিণ এশিয়া বিশেষত বাংলাদেশে এই সমস্যার প্রাদুর্ভাব আরও উদ্বেগজনক।
বিজ্ঞাপন
রাজধানী ঢাকায় পরিচালিত এক গবেষণায় ঢাকার প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ১৮ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত বলে জানা গেছে। বায়ুদূষণ, দীর্ঘ সময় স্ক্রিন ব্যবহার, এবং জলবায়ুর পরিবর্তন এই সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়া পরিস্থিতি
পরিবেশ, জীবনযাত্রার ধরন এবং স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতার কারণে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ড্রাই আই সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে। যদিও পুরো অঞ্চলের জন্য এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান সীমিত। তবে বিভিন্ন গবেষণায় এই সমস্যার প্রকোপ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ায় ড্রাই আই সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের হার প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। শহুরে এলাকা যেখানে স্ক্রিন ব্যবহারের মাত্রা উচ্চ এবং বায়ুদূষণ গুরুতর সেখানে এই হার তুলনামূলক বেশি।
ভারতে ৯ হাজার ৭৩৫ জন মানুষের মধ্যে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ভারতের শহুরে এলাকায় প্রায় ২২ থেকে ২৬ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ড্রাই আই সমস্যায় ভোগেন। অপরদিকে গ্রামীণ এলাকায় এই হার তুলনামূলক কম। তাও ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। পাকিস্তানে প্রায় ২৫ শতাংশ শহুরে কর্মজীবী ড্রাই আইয়ে আক্রান্ত। আর শ্রীলঙ্কা ও নেপালে তুলনামূলকভাবে ড্রাই আই’য়ের হার কম, কিন্তু উঁচু পাহাড়ি এলাকায় শুষ্ক বাতাসের কারণে এটি একটি প্রধান সমস্যা।
দক্ষিণ এশিয়ার বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ড্রাই আইয়ে আক্রান্ত। এর প্রধান কারণ হলো বয়সজনিত টিয়ার ফিল্ম ঘাটতি। তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ড্রাই আই সমস্যা বাড়তির দিকে, যা ১৫ শতাংশের বেশি। ডিজিটাল স্ক্রিন ব্যবহার, অফিসের এয়ার কন্ডিশনিং এবং পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া এর প্রধানতম কারণ।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি
বাংলাদেশে ড্রাই আই সংক্রান্ত গবেষণা খুবই কম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্স (ইনআইবিএমআর) বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুনের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি সমীক্ষা। ‘ঢাকার শহরাঞ্চলে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ড্রাই আই সিনড্রোমের প্রাদুর্ভাব’ শীর্ষক এই গবেষণায় মোট ১ হাজার ৫০০ মানুষ অংশগ্রহণ করেন। যা ওই বছর জার্নাল অব ওকুলার ফার্মাকোলজি অ্যান্ড থেরাপিউটিক্সে প্রকাশিত হয়।
গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, মোট অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ড্রাই আই সিনড্রোমে আক্রান্ত। যার মধ্যে ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি ছিল, যা প্রায় ৩০ শতাংশ। এছাড়া অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৬৫ শতাংশ জানান যে তাদের কাজ স্ক্রিন নির্ভর এবং প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যাপ্ত পানি পান করেন না।
এতে পুরুষ এবং নারীর মধ্যে প্রাদুর্ভাবের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায়নি। তবে, নারীদের মধ্যে মেনোপজ-পরবর্তী পর্যায়ে ঝুঁকি বেশি বলে গবেষণা ফলাফলে উল্লেখ করা হয়।
জীবনাচার পরিবর্তনের পরামর্শ
জানতে চাইলে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহাকারী অধ্যাপক ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলা ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের চোখের একটি ব্লিঙ্কিং রিফ্লেক্স থাকে। কিন্তু আমরা যখন দীর্ঘসময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি তখন সেই ব্লিঙ্কিং রিফ্লেক্সটি নষ্ট হয়ে যায়। সাধারণ চোখ যখন ব্লিঙ্ক করে তখন আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ম অনুযায়ী ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড থেকে পানি এসে চোখটাকে ভিজিয়ে দেয়। কিন্তু যখন আমি ব্লিঙ্ক করব না, তখন চোখে পানি আসবে না। চোখ ভেজার এ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যঘাত ঘটাকে আই ড্রাইনেস বলে।
লক্ষণ ও কারণ জানাতে গিয়ে ডা. যাকিয়া বলেন, বেশ কিছু লক্ষণ দেখে ড্রাই আই সমস্যা চিহ্নিত করা যায়। এর মধ্যে চোখ খচখচ করবে, অল্পতেই লাল হয়ে যাবে, শুকনা শুকনা লাগবে, সূর্যের আলোতে যেতে সমস্যা হয়। তবে এসব ক্ষেত্রে কান্না করলে চোখ থেকে পানি বের না হওয়ার সম্পর্ক আমি পাইনি। ড্রাইনেসের বেশ কিছু প্রভাবক রয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যারা ঘুমায় না, অন্ধকার রুমে স্ক্রিন দেখে, বাইক চালায়, দীর্ঘ সময় এসি রুমে থাকে, আইটি সেক্টরে কাজ করে এই গ্রুপটির ড্রাই আইয়ের সমস্যা বেশি দেখা দেয়। এছাড়া বয়স্কদের মধ্যে ড্রাই আই সমস্যা দেখা যায়। বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে। কিছু রোগের ক্ষেত্রেও ডাই আই সমস্যা দেখা দেয়।
ঝুঁকি ও প্রতিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে এই চোখ ও রেটিনা বিশেষজ্ঞ বলেন, এটা দীর্ঘমেয়াদে চোখের ভিশনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাই এ সমস্যা দূর করতে লাইফ স্টাইল মডিফিকেশন প্রয়োজন। অর্থাৎ স্ক্রিনের অতিরিক্ত সময় দেওয়া যাবে না, বিনোদনের জন্য স্ক্রিনের বিকল্পে অভ্যস্ত হবে। এক্ষেত্রে বই পড়া, খোলামেলা স্থানে সময় কাটানো, নিয়মিত চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় চোখের ড্রাইনেস সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব তবে জীবনাচার পরিবর্তন সবচেয়ে জরুরি। এছাড়া ড্রাই আই সমস্যা বাড়ার পেছনে পরিবেশ দূষণের প্রভাব রয়েছে বলেও জানান এই চিকিৎসক।
এমএইচ/এমআর