শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

নিউমোনিয়ার নতুন ধরনে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে শিশুর

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ পিএম

শেয়ার করুন:

নিউমোনিয়ার নতুন ধরনে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে শিশুর

নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুই মাস ধরে রাজধানীর শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশু আবির। নির্ধারিত বয়সে নিউমোনিয়ার টিকা দেওয়া হলেও ছয় মাস বয়স থেকে সর্দি-জ্বর লেগেই আছে এক বছর বয়সী শিশুটির। আবিরের চিকিৎসায় ইতোমধ্যে ২০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার মা সায়মা আক্তার।

একই রোগে প্রায় এক বছর ধরে ভুগছে চার বছরের শিশু রাইসাও। আবিরের মতো সেও রাজধানীর শিশু হাসপাতালে ভর্তি। শিশুটির বাবা জামাল শেখ বলেন, মেয়ের চিকিৎসায় তিনিও ২০ থেকে ২২ লাখ টাকার মতো খরচ করেছেন। সরকার থেকে দেওয়া সব টিকা নেওয়ার পরও রাইসার বারবার নিউমোনিয়ায় হচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা ওষুধপত্রের পেছনে ব্যয় হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন

ঋতু পরিবর্তনজনিত জ্বর-সর্দির প্রকোপ সারাদেশে

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। শত বছর ধরে এ রোগের জন্য দায়ী ছিল ‘নিউমোকক্কাল ও হিমোফিলাস’ ভাইরাস। কিন্তু বর্তমানে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ‘রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস’ (আরএসভি) নামে নতুন ধরনে। এখন পর্যন্ত যার কোনো কার্যকর টিকা নেই।

দেশে নিউমোনিয়া পরিস্থিতি

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের (বিডিএইচএস) ২০২২ সালের তথ্য অনুসারে, ২০১১ সালে জীবিত-জন্ম নেওয়া পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মধ্যে প্রতি হাজারে ১১ দশমিক ৭ শিশুর মৃত্যু হতো নিউমোনিয়ায়। ২০১৭-২০১৮ সালে এটি কমে হয় ৮ এবং ২০২২ সালে কমে আসে ৭.৪ শতাংশে। যদিও দেশে কত সংখ্যক শিশু নিউমোনিয়া আক্রান্ত হচ্ছে বা মারা যাচ্ছে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) সবশেষ তথ্যমতে, দেশে বছরে মারা যাচ্ছে ২৪ হাজার শিশু। ছয় লাখ ৭৭ হাজার শিশু নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মোটাদাগে তিন কারণে নিউমোনিয়া আক্রান্ত কমানো যাচ্ছে না। প্রথমত, ভাইরাসের ধরন অনুযায়ী নতুন টিকা না থাকা, বায়ুমানে অবনতি এবং আবদ্ধ ঘরে রান্নার ধোঁয়া থাকায়।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, নিউমোনিয়া কোন জীবাণু দ্বারা হচ্ছে সেটির ৫০ শতাংশই এখনও অজানা। সেটি কি ভাইরাসের মাধ্যমে হচ্ছে, নাকি ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে তাও জানা নেই। নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে হলে এর কারণ জানার উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রতিকূল পরিস্থিতি এবং সীমাবদ্ধতা

আইসিডিডিআরবির মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী ডা. আহমদ এহসানুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, নিউমোনিয়া প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান উপায় হলো টিকা। এ লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে দেশে হিব-পিসিভি টিকা দেওয়া হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এগুলো শুধুমাত্র নিউমোকক্কাল ও হিমোফিলাস ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর। বর্তমানে যে আরএসভি ভাইরাসটি বেশি সক্রিয় তার জন্য কোনো টিকা এখনও ইপিআই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বিশ্বে এ টিকার গবেষণাও পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

আরও পড়ুন

সুস্থ হলেও দীর্ঘসময় ভোগাচ্ছে ডেঙ্গু, প্রভাব ফেলেছে মানসিক স্বাস্থ্যেও

আহমদ এহসানুর রহমান আরও বলেন, নিউমোনিয়া কম হয় যখন বাতাস বিশুদ্ধ থাকে। কিন্তু ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর বাতাসের মান ক্রমেই খারাপ হচ্ছে, যা নিউমোনিয়ার হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বায়ু দূষণ প্রতিরোধে সরকারের কার্যক্রম তেমন একটা দৃশ্যমান না।

অ্যান্টিবায়োটিক ও অক্সিজেন ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি

এদিকে দেশে নিউমোনিয়া ব্যবস্থাপনায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে অনিয়ম রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ শিশু সঠিক সময়ে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক পায় না। এছাড়া অক্সিজেন সরবরাহেও সমস্যা রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে সঠিক প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে অক্সিজেন দেওয়া হয় না।

এ সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে ডা. আহমদ এহসান বলেন, নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় বিপদজনক পরিস্থিতি শনাক্ত করা, অক্সিজেন স্বল্পতা নিরুপণ এবং যথাযথ ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া জরুরি। হাসপাতালের ভেতরে যাদের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে সঠিক সময়ে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রায় এক-চতুর্থাংশ। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবস্থাপনায় আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ। এর কোনো পরিবর্তন আনা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন

মায়ের দুধে নিউমোনিয়ার সম্ভাবনা কমে ১৫ ভাগ

অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে আহমদ এহসান বলেন, অক্সিজেন পাওয়ার ক্ষেত্রে দুটি তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা ছিল কি না। দ্বিতীয়ত অক্সিজেন দেওয়ার পর তা ঠিক হলো কি না। কিন্তু এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। গবেষণায় শতকরা পাঁচটি শিশুও পাওয়া যায়নি যাদের অক্সিজেন স্বল্পতার বিষয়ে সঠিক তথ্য ছিল। অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে অন্ধের মতো। ফলে যার দরকার ছিল সে হয়তো পাচ্ছে না। আর যার দরকার নেই তাকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। এভাবে অক্সিজেন নষ্ট হচ্ছে। যা নিউমোনিয়া আক্রান্তদের মৃত্যু কমাতে কোনো প্রভাব ফেলছে না।

অর্থাৎ নিউমোনিয়া ব্যবস্থাপনাগত সীমাবদ্ধতার জন্য শিশুরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছে না এবং অক্সিজেনের অপচয় হচ্ছে। এ ধরনের ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে জরুরি পদক্ষেপ না নিলে শিশুমৃত্যু হ্রাসে বড় প্রভাব পড়বে না বলে জানান আইসিডিডিআরবির মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের এই বিজ্ঞানী।

এমএইচ/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর