বিগত সরকারের আমলে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ ও দায়ীদের বিচারসহ স্বাস্থ্যখাত সংস্কারে ১৭টি দাবি জানিয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস প্লাটফর্ম ফর পিপলস হেলথ (ডিপিপিএইচ)। এ সময় স্বাস্থ্যখাতের গুরুত্ব বিবেচনায় বর্তমান উপদেষ্টাকে দুর্বল উল্লেখ করে তাকে পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনের নেতারা।
বুধবার (১৬ অক্টোবর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়।
বিজ্ঞাপন
আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, দেশের স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি ঘটলেও একটি স্বাধীন দেশের ৫৩ বছরের সময় বিবেচনায় তা যতসামান্যই বলা যায়। স্বাস্থ্য সেবা ও মেডিকেল শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে দীর্ঘদিন ধরে চলছে নানা অনিয়ম, সীমাহীন দুর্নীতি, দুঃশাসন, দুর্বৃত্তায়ন ও অব্যবস্থাপনা যা বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ের রাষ্ট্রীয় চৌর্যবৃত্তি, অপরাজনীতি ও অনৈতিকতারই প্রতিফলন।
তারা আরও বলেন, স্বাস্থ্যকে জনগণের মৌলিক অধিকার বিবেচনায় এর দায়ভার সরকার নিজের কাঁধে নেওয়ার কথা। কিন্তু এর পরিবর্তে ক্রমান্বয়ে তা আরও বেশি করে জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্যের ব্যয় মেটাতে গিয়ে জনগণের পকেট খরচ ২০১২ সালের ৬৪ শতাংশের জায়গায় ২০২৩ সালে এসে ৭৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অথচ ২০১২ সালের সরকার নির্ধারিত 'স্বাস্থ্য অর্থায়ন কৌশল পত্রে' এ ব্যয় কমিয়ে ২০৩০ সালে ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ফলে স্বাস্থ্যের ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে।
মুখে স্বাস্থ্যকে সেবা হিসেবে উল্লেখ করলেও বাস্তবে সরকারের নীতি ও কৌশলে তা পণ্যে পরিণত করা হয়েছে এবং এক্ষেত্রে বাজার অর্থনীতির সকল অনুষঙ্গ চালু করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন আলোচকরা।
এদিন আলোচনাকালে অভ্যুত্থান পরবর্তী স্বাস্থ্যখাতের জন্য বর্তমান স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে দুর্বল উল্লেখ করে এই পদে পরিবর্তন আনার দাবি জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
বিজ্ঞাপন
অলোচনায় অংশ নিয়ে আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাক আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্যখাতের মানোন্নয়ন ও সেবা নিশ্চিতে চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। স্বাস্থ্যখাত থেকে টাকা যেন অন্য কোথাও কেটে না নেওয়া হয় সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে।
এ সময় ডিপিপিএইচের পক্ষ থেকে ১৭ দফা দাবি জানানো হয়৷এগুলো হলো:
১. স্বাস্থ্যকে জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান এবং আইন ও বিধি দ্বারা তা নিশ্চিত করা।
২. 'সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা' নিশ্চিত করতে জনস্বাস্থ্য ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যাকে প্রাধান্য দিয়ে গণমুখী স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩. ১৯৮২ সালে ঘোষিত ঔষধনীতির মূল কাঠামো ও লক্ষ্য ঠিক রেখে হালনাগাদকরণ ও বাস্তায়ন করতে হবে। সেই সঙ্গে ঔষধের মূল্য ও মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৪. বিগত আমলের স্বাস্থ্যখাতে সকল দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং সংশ্লিষ্ট সকলের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শান্তি প্রদান করতে হবে।
৫. ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে যুক্ত থাকা সকল চিকিৎসক সংগঠনের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ও দক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে।
৬. সরকারি হাসপাতালে ইউজার ফি বাতিল এবং এ পর্যন্ত আদায়কৃত ইউজার ফি এর স্বচ্ছ হিসাব প্রকাশ করা।
৭. চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, হাসপাতাল ও রোগীর নিরাপত্তার জন্য রোগী-চিকিৎসাকর্মী বান্ধব সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।
৮. স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বৃদ্ধি করে (এখনই জাতীয় বাজেটের ৮% ও ক্রমান্বয়ে ১৫% এবং জিডিপির ২% ও ক্রমান্বয়ে ৫%) এ উন্নীত করতে হবে।
৯. সরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক থেকে বিশেষায়িত পর্যন্ত সকল চিকিৎসা বিনামূল্যে প্রদান, পর্যাপ্ত ঔষধ ও চিকিৎসা সামগ্রী সংস্থান করতে হবে। চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও উপকরণ এবং প্রয়োজনীয় সকল প্রকার টিকাসামগ্রী সরকারিভাবে উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
১০. উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালসমূহ ১০০ শয্যা ও জেলা পর্যায়ে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার সুপারিশ অনুযায়ী হাসপাতালসমূহে শয্যা অনুপাতে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ প্রদান করতে হবে।
১১. দেশের জন্য উপযুক্ত রেফারাল পদ্ধতি চালু করতে হবে।
১২. শিল্পায়ন, নগরায়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবহনের নামে বন উজাড়, নদী ভরাটসহ পরিবেশ বিধ্বংসী সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
১৩. জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা চালু রেখে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে পরিকল্পিত নিয়োগ, বদলি বা পদপরিবর্তন এবং চিকিৎসা সহায়ক শূন্য পদগুলোতে দ্রুত নিয়োগ প্রদান করতে হবে।
১৪. মানহীন মেডিকেল কলেজ বন্ধ করতে হবে। দালাল ও কমিশন-বাণিজ্যমুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১৫. বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অভিন্ন চাকরির বিধিমালা ও বেতন কাঠামো প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১৬. আইএলও সনদ আনুযায়ী কলকারখানা-চিকিৎসাকেন্দ্র তৈরি এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ ও জনবলের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৭. গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং শহরাঞ্চলেও স্বাস্থ্যসেবায় অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এমএইচ/এমএইচএম

