রোববার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

ভংয়কর রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি, সতর্ক থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ০১ জুন ২০২৪, ১১:৪৮ এএম

শেয়ার করুন:

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছাড়াল ১৫ হাজার, নতুন মৃত্যু ৩

কোভিড পরবর্তী সময়ে দেশের প্রধান স্বাস্থ্য ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেঙ্গু জ্বর। ২০২৩ সালে ভয়াবহ তাণ্ডব চালানো এডিস মশাবাহিত এই জ্বরের ধারবাহিকতা রয়েছে চলতি বছরেও। এরমধ্যে প্রাক-বর্ষা মশা জরিপে রাজধানীর ১৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ বসতবাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে, যা গত প্রাক-বর্ষা মৌসুমে ছিল ৪ দশমিক শুন্য তিন শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় রাজধানীর বাসাবাড়িতে এডিস মশার ঘনত্ব বেড়েছে সাড়ে তিন গুনেরও বেশি। এ অবস্থায় চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞরা। সেজন্য সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা বছরে তিনবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মশার বিষয়ে জরিপ করে থাকে। এগুলো হলো, প্রাক-বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী জরিপ। গত ২৮ মে স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রাক-বর্ষা এডিস সার্ভে ২০২৪ এর ফলাফল প্রকাশ করে। জাতীয় ম্যালেরিয়া ও এডিস বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত এডিস মশার ঘনত্ব ও প্রজনন স্থান নিরীক্ষার জন্য এ জরিপ কাজ পরিচালনা করা হয়। এতে দুই সিটি করপোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডে মশার ঘনত্ব নির্দিষ্ট সূচকের চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৮টি ওয়ার্ড সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।


বিজ্ঞাপন


জরিপ ও ফলাফল

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৯৯টি ওয়ার্ডে ২১টি টিমের মাধ্যমে জরিপ পরিচালনা করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। প্রতি ওয়ার্ড ৮টি ব্লকে ভাগ করে দুটি টিম ৪টি ব্লকে ১৫টি করে প্রতি ওয়ার্ডে ৩০টি বাড়িতে জরিপ পরিচালনা করেন। ১০ দিনে ৯৯টি ওয়ার্ডে সর্বমোট ৩ হাজার ১৫২টি বাড়িতে জরিপ করা হয়। তাছাড়া যেসব ওয়ার্ডে বাড়ির সংখ্যা বেশি ও এলাকা বড় সেগুলোতে ৩-৫টি টিমের মাধ্যমে জরিপ পরিচালনা করা হয়।

আরও পড়ুন

ঢাকার যেসব ওয়ার্ড ডেঙ্গুর ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’

এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ নামে পরিচিত। স্বীকৃত এই মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের ওপরে হলে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে মনে করা হয়। আর হাউজ ইনডেক্স ১০ শতাংশের বেশি হলে তা ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডে মশার ঘনত্ব নির্দিষ্ট সূচকের চেয়ে বেশি, যা ডেঙ্গু রোগের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ১৮টি ওয়ার্ড সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।


বিজ্ঞাপন


ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৩ নাম্বার ওয়ার্ডে সবচেয়ে বেশি মশার ঘনত্ব পাওয়া যায়। এই ওয়ার্ডের ব্রুটো ইনডেক্স ছিল ৭৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এই ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত এলাকাগুলো হলো- চামেলীবাগ, আমিনবাগ, রাজারবাগ, নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন  জিপিও, বিজয়নগর, ট্রাফিক পুলিশ ব্যারাক ও শান্তিনগর এলাকা। দক্ষিণ সিটির বাকি ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হচ্ছে ৪, ৫২, ৫৪, ১৬, ৩, ৫, ১৫, ১৭ ও ২৩।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মধ্যে সবোর্চ্চ ব্রুটো ইনডেক্স ৪৩ দশমিক ৩৩ ছিল ১২ নাম্বার ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত এলাকাগুলো হলো, আহম্মদনগর (আংশিক), শাহআলীবাগ, দক্ষিণ বিশিল, পাইকপাড়া, টোলারবাগ (উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ)। উত্তর সিটির ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হচ্ছে ১২, ১৩, ২০, ৩৬, ৩১, ৩২, ১৭ ও ৩৩।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর যে ৪৬৩টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা ও পিউপা (লার্ভার পরের স্তর) পেয়েছে তার মধ্যে বহুতল ভবনে ৪২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। স্বতন্ত্র বাড়িতে ২১ দশমিক ৬ শতাংশ, নির্মাণাধীন বাড়িতে ২১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং সেমিপাকা বাড়িতে ১২ দশমিক ৭৪ শতাংশ লার্ভা পাওয়া যায়। আর উত্তর সিটিতে গড় ব্রটো ইনডেক্স ১৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং হাউস ইনডেক্স ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। এছাড়া দক্ষিণ সিটিতে ব্রুটো ইনডেক্স ১৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং হাউস ইনডেক্স ১৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে কথা হয় শুধু ঢাকাকেন্দ্রীক। শুধু ঢাকার জরিপ করে সারাদেশের পরিস্থিতি বুঝা সম্ভব না। সারাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে গেছে। এ নিয়ে পরস্পরকে দোষারোপের সুযোগ নাই। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে তাদের কাজ অল্প। স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ হলো সঠিকভাবে রোগী ব্যবস্থাপনা করা। শয্যা, ওষুধ ও স্যালাইন নিশ্চিত করা তাদের কাজ। অনেক বেশি রোগী আসলে, সেখানে জটিল কারও কারও মৃত্যু ঘটবে। কারণ রোগটা অনিশ্চিত। এর নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। যে চিকিৎসা দেওয়া হয়, তা সাপোর্টিভ ও লক্ষণভিত্তিক। তাই রোগী আসা বন্ধ করতে হবে।-বলেন এ বি এম আব্দুল্লাহ।

আরও পড়ুন

ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ‘ভয়ংকর’ হওয়ার শঙ্কা

এই চিকিৎসক আরও বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। সবাইকে কাজ করতে হবে। সিটি করপোরেশনকে মশা মারতে হবে। তবে এক্ষেত্রেও রাজউক, ওয়াসা, ভূমি মন্ত্রণালয়কেও কাজ করতে হবে। যেমন ক্যান্টনমেন্ট ও এয়ারপোর্ট এলাকায় সিটি করপোরেশন ঢুকতেই পারবে না। ওই স্থানগুলোতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে। সমন্বয় করে কাজ না করলে লাভবান হওয়া যাবে না। দক্ষিণ যদি মশা মারা শুরু করে আর উত্তর কিছু না করে, তাহলে উত্তরের মশা সব দক্ষিণে চলে আসবে। তাই সমন্বয়টা জরুরি। মশা নিধন সম্ভব না কিন্তু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার শঙ্কা

গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও অনেক বেশি খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বেশি পরিমাণে লার্ভা পাওয়া প্রমাণ করে যে, গত বছর ও চলতি বছরের শুরু থেকে মশা মারার কোনো কার্যক্রম সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। কার্যক্রম ঠিকভাবে করলে এই লার্ভাগুলো পাওয়া যাওয়ার কথা না। এজন্য আমাদের ঢাকাবাসীর সচেতনতার অভাব ও এগুলো বেশিরভাগই বাসা বাড়িতে জমা পানি ও নির্মাণকাজের স্থলে হয়েছে। রাজধানীর অনেক সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে।

আরও পড়ুন

মে মাসে ডেঙ্গুতে ১১ মৃত্যু, হাসপাতালে ৬৪৪

সংশ্লিষ্টরা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না উল্লেখ করে জামিল ফয়সাল বলেন, দুই সিটির ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের তত্ত্বাবধানে ওষুধ ছিটানোর কথা। এটি একদমই হচ্ছে বলে মনে হয় না। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ধোঁয়া দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ এই কাজে কোনো সফলতা পাওয়া যাবে না। এটি ধারাবাহিকভাবে করতে হবে।

জরিপ অনুযায়ী ১৮টি ওয়ার্ড অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ওইগুলোতে হটস্পট ম্যানেজমেন্টের মতো করে কাজ করা উচিত। অর্থাৎ প্রতিদিন মশার ওষুধ দিতে হবে। এটি লার্ভিসাইড ও মসকিটোসাইড দুইটাই দিতে হবে। কিন্তু প্রতিদিন তো অনেক দূরের কথা, সপ্তাহে একদিনও দেওয়া হচ্ছে না।

নাগরিকদের সচেতন হতে হবে

অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, সিটি করপোরেশনের অধীনে থাকা নাগরিকদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ঢাকার ২০-২৫ তলা ভবনে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সিটি করপোরেশন গিয়ে মশা মারতে পারবে না। এটা জনগণকে করতে হবে। এডিস গৃহপালিত ও ভদ্র মশা। এরা সুন্দর সুন্দর বাড়ি-ঘরে জন্মায় ও বসবাস করে। সাধারণত পরিষ্কার পানিতেই এর জন্ম। নোংরা পানিতে জন্মায় বলে ইদানীং শোনা যাচ্ছে। কিন্তু তা খুবই বিরল ঘটনা।

আরও পড়ুন

গাজীপুরে চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু

মানুষকে সচেতন করতে বেশি বেশি ডেঙ্গুর কথা বলতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে এটি শুধু ঢাকা বা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনভিত্তিক না। সারাদেশেই ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। বরং সিটির বাইরেই বেশি রোগী দেখা যাচ্ছে। ফলে কর্তৃপক্ষ ও জনগণকে সচেতন হতে হবে। সবাইকে মশা মারার উদ্যোগ নিতে হবে, কামড় খাওয়া থেকে বেঁচে থাকতে হবে বলে জানান প্রখ্যাত এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।

সবচেয়ে জরুরি মশা মারা

ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হলো তার সেবাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রস্তুত করা। তবে এর থেকেও জরুরি হলো মশা মারা। এটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের করার কথা। এক্ষেত্রে তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে কাজ করবে। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের মূল কাজ রোগী বেশি করে আসলে তাদের যেন চিকিৎসা দিতে পারে। তারা তা করছে বলে জানিয়েছে। কিন্তু মশা মারার কাজটি স্থানীয় সরকার বিভাগকেই করতে হবে।

ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ঢাকার বাইরে অধিক পরিমাণে আক্রান্তের ঝুঁকি রয়েছে। ঢাকায় সাংবাদিকদের লেখালেখির কারণে মশা নিয়ন্ত্রণে কিছুটা তৎপরতা রয়েছে। রাজধানীর বাইরে তার কিছুই নেই। ফলে বাইরে এবার পরিস্থিতি খুবই ভয়ঙ্কর হবে। এটি যেন না হয় সে বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। সরকারের এ কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় হতে হবে এবং মানুষকে সচেতন হতে হবে।

এমএইচ/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর