সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

নিউরোসায়েন্সের লিফট রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা পেয়েছে তদন্ত কমিটি 

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২১ মে ২০২৪, ০৩:৩৪ পিএম

শেয়ার করুন:

নিউরোসায়েন্সের লিফট রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা পেয়েছে তদন্ত কমিটি 

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে গত ৩১ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনকে বহনকারী লিফট দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে লিফট রক্ষণাবেক্ষণসহ লিফট অপারেটরের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।

নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রীর লিফটে আটকে যাওয়া সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।


বিজ্ঞাপন


প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, দুর্ঘটনাকবলিত ১০০০ কেজি ধারণ ক্ষমতার লিফটটি ‘মান বংলাদেশ লিমিটেড’ কর্তৃক সিগমা (ম্যানুফেকচার বাই ওটিআইসস এলিভেটর, কোরিয়া) ব্র্যান্ডের স্থাপিত। লিফটটি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করা হয়। এরপর থেকে প্রায় ১২ বছর যাবৎ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লিফটটি নিরবিছিন্ন পরিচালনার স্বার্থে চলতি অর্থ বছরে মাসিক সার্ভিসিং এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একই প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তারা নিয়মিত সার্ভিসিং করছে।

তদন্ত কমিটির পরিদর্শনকালে লিফটটি চলাচলে কোনো সমস্যা পাওয়া না গেলেও লিফট সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির বক্তব্য ও অন্যান্য তথ্যাবলী পর্যালোচনা করে বেশকিছু ত্রুটির তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। এগুলো হলো—

১. গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-৭, ঢাকার নির্বাহী প্রকৌশলী, সংশ্লিষ্ট উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (ই/এম) এবং সংশ্লিষ্ট উপ-সহকারী (ই/এম) এর লিফট রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের প্রতি নির্দেশ প্রদান করলেও যথাযথভাবে প্রত্যক্ষ কাজ তদারকিতে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়।

২. লিফট পরিচালনার জন্য স্থিতিশীল ভোল্টেজ সম্বলিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করার লক্ষ্যে স্থাপিত অটোমেটিক ভোল্টেজ রেগুলেটর (এভিআর) ডিভাইসটি অকেজো অবস্থায় রয়েছে।


বিজ্ঞাপন


৩. লিফট চলাচলের সময়ে কোনো কারণে বিদ্যুৎ চলে গেলে বা অন্য কোনো কারণে লিফট দুই ফ্লোরের মধ্যবর্তী স্থানে বন্ধ হয়ে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিকটস্থ ফ্লোর লেভেলে লিফট নিয়ে যাওয়ার জন্য অটোমেটিক রেসকিউ ডিভাইস (এআরডি) স্থাপিত নেই।

৪. লিফটের মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে বিবেচিত কন্ট্রোল প্যানেল মাইক্রোপ্রসেসর ও বিভিন্ন সেমিকন্ডাকটর দিয়ে তৈরি যা নির্ধারিত তাপমাত্রায় রেখে ব্যবহারে কন্ট্রোল রুমে এয়ার কুলার স্থাপন করা হয়ে থাকে। কন্ট্রোল রুমে এয়ারকুলার থাকলেও অকেজো অবস্থায় রয়েছে।

৫. লিফট সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যাক্তিদের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে লিফটটিতে অতিরিক্ত লোক উঠলেও ওভার লোড সেন্সর কাজ করেনি। বিদ্যুৎ সরবরাহ সিস্টেমে ভোন্টেজ ফ্লাকচুয়েট বা অন্য কোনো ত্রুটিজনিত কারণে নির্দিষ্ট লেভেলে থামার জন্য সুইচ বা কন্ট্রোলার যথাযথভাবে কাজ না করায় নির্ধারিত লেভেলে থামতে পারেনি।

৬. সংশ্লিষ্ট লিফট Manufacturer এর নির্দেশনা অনুয়ায়ী যে সকল ডিভাইস ও ফাংশন মাসিকভিত্তিতে পরীক্ষা করা প্রয়োজন সে সকল পরীক্ষা যথাযথভাবে হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

৭. সার্ভিসিং এবং রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের ওপর একক নির্ভরতা এবং কাজের সময়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলদের উপস্থিত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

৮. সাইটে অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স ম্যানুয়াল, অভিযোগ রেজিস্টার, সার্ভিসিং, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ হিস্টোরিবুক ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হযনি।

৯. লিফট অপারেটরের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও এমন অপারেটর নিয়োগ করা হয়েছে। এমনকি নিয়োগের পরও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়নি।

এ অবস্থায় তদন্ত কমিটির পক্ষথেকে ৯ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো—

১. সংশ্লিষ্ট লিফট ম্যানুফেকচারের নির্দেশনা অনুয়ায়ী সকল ডিভাইস ও ফাংশন মাসিকভিত্তিতে যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিশ্চিত করে চেক লিস্ট আকারে পরীক্ষার ফলাফল লিপিবদ্ধ করার জন্য নির্ধারিত ফরম এবং লগবুক প্রবর্তন করে সে অনুযায়ী গণপূর্ত অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার উপস্থিতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা।

২. সেফটি ডিভাইসগুলোর মধ্যে এক বা একাধিক ডিভাইস অকেজো হলে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় লিফট বন্ধ রাখা বা ব্যবহার না করা।

৩. এআরডি স্থাপন করা, এভিআর ও এয়ার কুলার মেরামত বা স্থাপনের ব্যবস্থা করা।

৪. সার্ভিসিং ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের ওপর একক নির্ভরতা কমাতে বা কাজের গুণগতমান নিশ্চিতে গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।

৫. সাইটে অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স ম্যানুয়াল, অভিযোগ রেজিস্টার, সার্ভিসিং, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ হিস্টোরিবুক ইত্যাদি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।

৬. লিফটের দরজা আওতাভুক্ত করে প্রতিটি ফ্লোরে সিসিটিভি সিস্টেমে নিয়ে আসা।

৭. যথাযথ প্রশিক্ষণ ব্যতিরেকে কোনো লিফট অপারেটর দ্বারা লিফট পরিচালনা না করা।

৮. সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের (উপ-সহকারী প্রকৌশলী, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী) হাসপাতালে ভিভিআইপি বা ভিআইপি আগমনের সময় অধিকতর সর্তকতা অবলম্বন করা।

৯. লিফট একটি ভার্টিক্যাল পরিবহন বিধায় অন্যান্য পরিবহনের ন্যয় ব্যবহারের পূর্বে ছাড়পত্র প্রদানের এবং ফিটনেস যাচাইয়ের জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া।

উল্লেখ্য, গত ৩১ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভায় যোগদান শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন হাসপাতালের আনুমানিক ৯ থেকে ১০ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১০ম তলা থেকে নিচতলায় নামার লক্ষ্যে লিফটে উঠেন। লিফটটি যাত্রা শুরু করে দ্বিতীয় তলার কাছাকাছি আসার সময়ে তারা একটি শব্দ শুনতে পান এবং লিফটটি থামার সময়ে আর একটি শব্দ শুনতে পান। লিফটটি থামার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরজা না খোলায় দায়িত্বরত লিফট অপারেটর পাশের লিফটের দায়িত্বে নিয়োজিত অপারেটরের সহায়তায় প্রায় ৭-৮ মিনিট পর দরজা খোলার ব্যবস্থা করেন। দরজা খোলার পর দেখা যায় লিফটটি নির্ধারিত নিচতলার মেঝের সমতলে না থেমে মেঝে থেকে অনেকটা নিচে থেমেছে। এ পরিস্থিতিতে লিফট অপারেটরের নির্ধারিত টুলের (বসার জন্য অস্থায়ী ব্যবস্থা) সহায়তায় মন্ত্রীসহ লিফটে থাকা অন্য কর্মকর্তাদের বের করে আনা হয়। এ ঘটনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী উম্মা ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

এমএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর