মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

কিডনি চিকিৎসার সামর্থ্য নেই ৯০ শতাংশ রোগীর

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ১৪ মার্চ ২০২৪, ০১:৪৩ পিএম

শেয়ার করুন:

কিডনি চিকিৎসার সামর্থ্য নেই ৯০ শতাংশ রোগীর
  • কিডনি বিকল রোগীর সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ হাজার
  • বছরে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পাঁচ হাজার মানুষের
  • বছরে প্রতিস্থাপন হয় ৩৬৫ জনের
  • কিডনি প্রতিস্থাপনের হার ৭ দশমিক ৩ শতাংশ

তিন বছর ধরে ক্রনিক কিডনি ডিজিজে (সিকেডি) ভুগছেন গাজীপুরের বাসিন্দা জামাল হোসেন (ছদ্মনাম)। যখন কিডনি রোগ শনাক্ত হয় ততদিনে তার দুটো কিডনিই প্রায় বিকল হয়ে পড়েছে। চিকিৎসকরা প্রতি সপ্তাহে দুইবার করে ডায়ালাইসিসে পরামর্শ দিয়েছেন তাকে। তবে আর্থিক সংস্থান না থাকায় মাসে এক বা দুটি ডায়ালাইসিসি নিচ্ছেন তিনি।


বিজ্ঞাপন


রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে (নিকডো) ডায়ালাইসিসি নেওয়া এই রোগী ঢাকা মেইলকে জানান, ঢাকায় আসা যাওয়া ইনজেকশন, নানাবিধ পরীক্ষা ও আনুসাঙ্গিক খরচ মিলে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা খরচ হয়। গরিব হওয়ায় এতো টাকা দেওয়ার সামর্থ নেই তার। তিনি বলেন, ‘এতো টাকা কোথায় পাবো? জমি বিক্রি করে চিকিৎসা চালাতে চালাতে এখন আমার কিছু নেই। সপ্তাহে দুইবার ডায়ালাইসিস করানোর কথা থাকলেও আমি নিচ্ছি মাসে।’

তারই মতো আরেক রোগী জাকির হোসেনের অবস্থাও একই। তারও দুটি কিডনি নষ্ট। কিডনি রোগ শনাক্তের পর থেকেই নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হচ্ছে তাকে। আর্থিক সমস্যার কথা জানিয়ে জাকির হোসেন বলেন, প্রথম দিকে নিজের জমানো টাকা খরচ করে চিকিৎসা নিয়েছি। এরপর জমি, বাড়ি বিক্রি করে চিকিৎসা করিয়েছি, ডায়ালাইসিস চালিয়েছি। চার বছর ধরে এভাবে চলতে চলতে নিঃস্ব হয়ে গেছি। সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কেউ যদি দয়া করে কিছু টাকা দেয় তাহলে ডায়ালাসিসি চলে নয়তো বন্ধ থাকে।

একাধিক রোগীর স্বজনের তথ্যমতে, সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতে আসা-যাওয়া ও আনুসাঙ্গিক খরচ মিলে প্রতিবার দুই থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে  ডায়লাইসিসে নুন্যতম ৭ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা লাগে। একজন রোগীর সপ্তাহে দুইবার ডায়লাইসিস করতে হয়। আবার কারও তিনবার করতে হয়। সেক্ষেত্রে খরচ আরও বেড়ে যায়। এছাড়াও কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস চলাকালে যেকোনো মুহূর্তে আইসিইউ বা অক্সিজেন নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। সেটারও বড় ধরনের খরচ রয়েছে। ফলে রোগীরা দীর্ঘমেয়াদে ডায়ালাইসিসও করাতে পারছেন না, মাঝপথেই থেমে যাচ্ছে অনেকের চিকিৎসা। অনেকে ব্যয় মেটাতে নিঃস্ব হচ্ছেন। আবার কেউ কেউ সহায়-সম্বল হারাচ্ছেন।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন

চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যথার ওষুধ, ঝুঁকিতে কিডনি

কিডনি চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে নানাবিধ কিডনি জটিলতায় ভোগা রোগীর সংখ্যা আনুমানিক ৩ কোটি ৮০ লাখ। যার মধ্যে কিডনি বিকল রোগীর সংখ্যা অন্তত ৪০ থেকে ৫০ হাজার। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ভেজাল খাদ্যগ্রহণ, ধূমপানসহ অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও ব্যথানাশক সেবনের কারণে দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা ক্রমে বেড়েই চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কিডনি রোগের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসা অব্যাহত রাখতে পারছেন না। এতে মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, যা তার জন্য বয়ে আনছে নিদারুণ কষ্ট এবং অকাল মৃত্যু।

সচেতন হওয়ার তাগিদ

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের তথ্যমতে, হাসপাতালটিতে সিডিউল পাওয়া একজন রোগীর প্রতিবার ডায়ালাইসিসের জন্য খরচ নেওয়া হয় ৫৬৩ টাকা। আর সিডিউল ছাড়া প্রতিবার ডায়ালিসিসের জন্য খরচ হচ্ছে ৩ হাজার ৮০ টাকা। অর্থাৎ প্রতিমাসে দুটি হিসেবে সাধারণ রোগীদের ৮টি ডায়ালিসিসের খরচ হচ্ছে ২৪ হাজার ৬৪০ টাকা। বেসরকারি হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মান বিবেচনায় এ খরচ আরও বহুগুণ বেশি। এছাড়া যাতায়াত, হাসপাতালে অবস্থান, ওষুধ ও ডায়ালাইসিসি সংক্রান্ত আনুসঙ্গিক খরচ তো আছেই।

এমন অবস্থায় সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞদের। চিকিৎসকরা বলছেন, কিডনি মানব শরীরে অনেকটা ফিল্টারের মতো কাজ করে। এটি শরীরের দূষিত ও ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দেয়। কিন্তু কিডনি যদি সে কাজ করার সক্ষমতা হারায় তখন তাকে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ বলা হয়। এ অবস্থায় রোগীর জন্য দুটি পথ খোলা থাকে। একটি ডায়ালাইসিসি অথবা কিডনি প্রতিস্থাপন, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে প্রাথমিক অবস্থায় রোগটি ধরা পড়লে চিকিৎসা ও ওষুধের মাধ্যমে কিডনিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এতে খরচ ও ভোগান্তি উভয়ই কমে আসে।

আরও পড়ুন

কিডনি নষ্ট হলে যেসব লক্ষণ দেখা দেয়

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক হারুন-উর-রশিদ বলেন, শুরুর দিকে কিডনি রোগের কোনো উপসর্গ থাকে না। শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর উপসর্গ দেখা দেয়। আক্রান্তদের একটা বড় অংশ দীর্ঘমেয়াদে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভোগে। কিন্তু ৫৫ শতাংশ মানুষ জানেই না তার ডায়াবেটিস রয়েছে। আর উচ্চ রক্তচাপে ভোগাদের  ৬০ শতাংশ রোগীও তা জানে না। কারণ তারা চিকিৎসকের কাছে যায় না। এতে রোগটি ক্রনিক রূপ নেয় এবং নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হয়। কিডনি যদি অকেজো হয়ে যায় তাহলে কিডনি প্রতিস্থাপন ও ডায়ালাইসিস ছাড়া বাঁচার উপায় থাকে না। কিন্তু এই দুটি চিকিৎসা পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ৯০ শতাংশ রোগীর সেই সামর্থ্য না থাকায় মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়।

বাড়াতে হবে কিডনি প্রতিস্থাপন

দেশে কিডনি রোগ পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রতিস্থাপন বাড়াতে হবে বলে মনে করেন ইউরোলজি বিশেষজ্ঞ ও সার্জন অধ্যাপক ডা. মো. শওকত আলম। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, দেশে প্রতিবছর পাঁচ হাজার মানুষের কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে সর্বোচ্চ ৩৬৫ জনের। যা প্রয়োজনের মাত্র ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশে কিডনি দাতার সংকট রয়েছে। একইসঙ্গে এ বিষয়ক আইনি জটিলতাও রয়েছে। এছাড়া বছরে আমাদের দেশে যে পরিমাণ অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রয়োজন, সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আমাদের দক্ষ লোকবল তৈরি করতে হবে। এ খাতে সরকারের কোনো বরাদ্দও নেই। ফলে রোগীরা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।

দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের তথ্য তুলে ধরে শওকত আলম জানান, বাংলাদেশে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় ১৯৮২ সালে। আর দ্বিতীয় প্রতিস্থাপনটি হয় ১৯৮৮ সালে। এর ধারাবাহিকতায় এ পর্যন্ত তিন হাজার ৬৫ কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় তা খুবই কম।

এমএইচ/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর