নভেম্বরের শেষে এসেও এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ অব্যাহত রয়েছে। এর জন্য বিশেষজ্ঞরা যথাসময়ে ব্যবস্থা না নেওয়াকে দায়ী করেছেন। যথাসময়ে ব্যবস্থা নিলে ডেঙ্গুর প্রকোপ এতটা ভয়াবহ রূপ নিত না বলে মনে করেন তারা। একটা সময় ঢাকাতে সবচেয়ে বেশি রোগী থাকলেও এখন তা সারাদেশে প্রায় সমান হয়ে গেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার (২৫ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে (নিপসম) এপিডেমিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ আয়োজিত ‘ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিলে বক্তারা এসব কথা বলেন।
বিজ্ঞাপন
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। তবে এবছরে আমরা ডেন-২ এবং ডেন-৩ সেরোটাইপটা বেশি পেয়েছি। ইতোমধ্যে সারাদেশেই ডেঙ্গু ছড়িয়েছে, তবে শনাক্ত এবং ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে ঢাকায় এবং বাইরে প্রায় সমান হয় গেছে। একটা সময়ে ছিল ঢাকাতে সবচেয়ে বেশি রোগী, এখন প্রায় সমান হয়ে গেছে। ২০২৩ সালের আউটব্রেকে আমরা দেখছি, ঢাকা শহরের প্রায় সব এলাকাতেই ডেঙ্গু রোগী। মোট সংক্রমণের ৩৫ শতাংশই ঢাকা এবং ৪৪ শতাংশ ঢাকার বাইরে থেকে আসছেন। এমনকি ৮৬ শতাংশ কেস শনাক্ত হয়েছে হাসপাতালের চারপাশে দুই কিলোমিটারের মধ্যে।’
আরও পড়ুন: কর্মসূচি না নিলে প্রতি বছরই ডেঙ্গু ভোগাবে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চলতি বছরের মে, জুন, জুলাই তিন মাসে এডিসের প্রজনন হার ছিল অনেকটাই বেশি। এই সময়টাতে বৃষ্টিও বেশি হয়। কাজেই আমরা যদি মশা নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, তাহলে এই সময়ে আগেই মশা নিয়ন্ত্রণের কাজটা করতে হবে। কিন্তু আমরা সময়মতো যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারিনি। ফলে ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।’
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে আইইডিসিআর সাবেক এই প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, এডিস একদিন কামড়ালে চার দিন পর আবার কামড়ায়। একটি এডিস মশা ৫০ দিন বেঁচে থাকলে তার লাইফটাইমে পরপর ১০ বার কামড়ায়।
বিজ্ঞাপন
আইইডিসিআরের অপর সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর হোসেন বলেন, করোনার সময় থেকে আমরা কমিউনিটি এঙ্গেজমেন্টের বিষয়ে চেষ্টা করেছি, কিন্তু এই বিষয়টাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। ডেঙ্গু প্রতিরোধেও কী কী করতে হবে আমরা সবাই জানি, কিন্তু মানি না। এখানেই হচ্ছে আমাদের মূল সমস্যা। ডেঙ্গু সংক্রমণের সেই শুরু থেকে আমরা বিভিন্ন ধরনের মিটিং-সেমিনার করেছি, কিন্তু এভাবে আমরা মিটিং করলে কী হবে? আমি আজ পর্যন্ত জানি না স্বাস্থ্য অধিদফতরে কোনো ধরনের টাস্কফোর্স কমিটি হয়েছে কি না। এক-দুইটা টেকনিক্যাল কমিটি হয়েছে, যার সর্বমোট মিটিং হয়েছে মাত্র তিনটা।
আরও পড়ুন: ‘শুধু ওষুধ ছিটিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়’
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ে পূর্বেই একটা ন্যাশনাল স্ট্রেটেজি তৈরি করা হয়েছিল। সেটা রিভিশনের জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের এক্সপার্ট অফার করেছি, সেটাও হয়নি। আমরা বলেছি, তাহলে আপনারা ডেভেলপমেন্ট পার্টনারদের ইনভলভ করেন। কারণ ডেঙ্গুতে প্রতিদিনই ডাবল ডিজিটের মানুষ মারা যাচ্ছে। আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোনো কন্ট্রোল প্রোগ্রাম দেখিনি। অথচ সবাই বিচ্ছিন্নভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছি। ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন নিয়ে আমরা যখন হাসপাতালগুলোতে কথা বলতে গিয়েছি, আমরা দেখেছি কমিউনিটি লেভেলে ট্রিটমেন্ট করার কোনো গাইডলাইন নেই। আমাদের ৮০ পেইজের একটা গাইডলাইন আছে, যেটা অধিকাংশ চিকিৎসকের ট্রিটমেন্টের সময় ফলো করা সম্ভব নয়। তখন আমরা ছোট করে একটা পকেট গাইডলাইন তৈরি করেছি, সেখানেও এখন পর্যন্ত যথেষ্ট তত্ত্ব-উপাত্ত এবং ক্লিনিক্যাল এক্সপেরিয়েন্সের অভাব রয়েছে। সেটা রিভিশনের জন্য বারবার বলা হলেও সেটা হচ্ছে না।
এ সময় ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্টের সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন আইইডিসিআরের সাবেক এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
ডেঙ্গুর ব্যবস্থাপনা নিয়ে অন্যান্য অলোচকরা বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে দেশ ও দেশের মানুষ যতোটা উদ্বিগ্ন ছিল, ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ে তার আংশিকও ছিল না। সরকার যেমন শুরুতে ডেঙ্গু মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি, সাধারণ মানুষের মধ্যেও কোনো সচেতনতা বা ভয় পরিলক্ষিত হয়নি। যে কারণে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু সংক্রমণ। এমনকি এক সময়ের ‘ঢাকার ডেঙ্গু’ এখন ঢাকার বাইরেও ব্যাপক আকারে বিস্তার লাভ করেছে।
আলোচকরা আরও বলেন, এত বড় একটা আউটব্রেক, ১৫০০ জনের অধিক মানুষ মারা গেল, প্রতিদিন ডাবল ডিজিটের মানুষ মারা গেল, অথচ সেটা নিয়ে আমরা কোনোদিন ইমারজেন্সি একটা মিটিং ডাকিনি। এ বিষয়গুলো আমাদের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু প্রতিরোধে সারা বছর সচেতন থাকতে হবে: ডিএনসিসি মেয়র
অনুষ্ঠানে উপস্থিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য) ডা. মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গুতে কোনো মৃত্যুই আমরা প্রত্যাশা করি না। যার একমাত্র আয়-রোজগারের মানুষটি মারা যায়, তারাই একমাত্র ভয়াবহতাটা বুঝতে পারে। এজন্য ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। আমরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদাভাবে কাজ করছি, আমাদেরও যথেষ্ট গ্যাপ রয়েছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে ডেঙ্গু নিয়ে আমরা আলোচনার টেবিলেই আটকে আছি। ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদের মাঠ পর্যায়ে যেতে হবে। হলরুম-সেমিনারে বসে শুধু গবেষণা আর বক্তব্য দিলেই হবে না।
করণীয় বিষয়ে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সবাইকে নিয়ে যৌথ কমিটি করে আমাদের কিছু ডকুমেন্টস বানাতে হবে। কাজের স্ট্রাকচার আগে থেকেই প্রস্তুত থাকবে। আমাদের আগে থেকেই অ্যাকশন প্ল্যান থাকবে। অনুযায়ী আমরা যদি কাজ করতে পারি, তাহলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
সংকটের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন,গণমাধ্যমসহ সব জায়গায় স্যালাইনসহ আমার সংকট নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, তখন আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেছি। আমাদের সরবরাহ শেষ হয়ে যাওয়ার পরই নতুন করে পাওয়ার ব্যাপারে আমরা সক্রিয় হয়েছি। কিন্তু একটা বিষয় আমাদের মাথায় রাখা উচিত, লজিস্টিক সাপোর্ট ও সিস্টেমের কারণে আমাদের সরবরাহ কার্যক্রম অনেক সময় ব্যাহত হতে পারে। এজন্য আমরা যা ব্যবহার করব, সেখান থেকে অন্তত ১০ শতাংশ সবসময় নিজের হাতে স্টক রাখতে হবে।
এমএইচ/জেবি