সারাবিশ্বে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ ক্যানসার। রোগটি পুরনো হলেও এর মৃত্যুর হার এখনো অনেক বেশি। কারণ প্রাথমিক অবস্থায় রোগটি সহজে ধরা পড়ে না। এছাড়া বাস্তবিক অর্থে এখনো পর্যন্ত ক্যানসারের চিকিৎসায় পুরোপুরি কার্যকর কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতির মাধ্যমে এটি নিরাময়ের চেষ্টা করা হয়। সারাবিশ্বে ২০০ এরও অধিক ধরনের ক্যানসার রয়েছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের স্তন ক্যানসার আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যানসারের প্রাণঘাতী এ ধরনটিতে নারীদের পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছেন পুরুষরাও।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের (আইএআরসি) তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতি বছর এক কোটি ৯৩ লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ছয় লাখ ৮৪ হাজার রোগী মারা যান। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর এক লাখ ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ৬০ হাজার মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ১৩ হাজার রোগী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। যা ক্যানসারে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে শতকরা ১৯ শতাংশ। একইসঙ্গে স্তন ক্যানসারে গড়ে মারা যান প্রায় ছয় হাজার ৭৮৩ জন মানুষ। এদের তিন-চতুর্থাংশ রোগীর স্তন ক্যানসার শেষ পর্যায়ে ধরা পড়ে। ফলে তাদের বাঁচানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
বিজ্ঞাপন
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে মোট ক্যানসার আক্রান্তদের মধ্যে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ স্তন ক্যানসারে ভোগেন। এর মধ্যে নারীর পাশাপাশি পুরুষরাও রয়েছেন। যেকোনো নারীই স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার কারণে রোগটির পরীক্ষা ও প্রকাশের বিষয়ে লজ্জাবোধে ভোগেন নারীরা। আর পুরুষরা নিজেদের স্তন ক্যানসার হতে পারে, তা বিশ্বাসই করতেই নারাজ। ফলে তারা স্ক্রিনিং কর্মসূচির আওতায় আসছেন না। তিন-চতুর্থাংশ রোগীর স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে রোগের শেষ পর্যায়ে। অথচ স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যানসার নির্ণয় করা গেলে এবং সময়মতো চিকিৎসা দিতে পারলে শতকরা ৯০ ভাগ রোগীর সুস্থ হয়।
স্তন ক্যানসার সচেতনতা ও নানা উদ্যোগ
স্তন ক্যানসার দেশের নারীদের অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্য ঝুঁকি। এ অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন সরাদেশে নিয়মিত স্ক্রিনিং কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তবে এর পরিধি কতটা সন্তুষ্টজনক তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। স্ক্রিনিং কার্যক্রমের বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার মিলিয়ে প্রায় ২৪ লাখ নারীর স্ক্রিনিং করা হয়েছে। যা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার তুলনায় নগণ্য।
বিজ্ঞাপন
সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময় বিনামূল্যে স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। তবে তা নির্দষ্ট দিবসকেন্দ্রিক। ফলে তা সামগ্রিকভাবে জনসাধরণের মধ্যে কতটা সচেতন করতে সক্ষম হচ্ছে তা বলা কঠিন। তেমনই একটি সংগঠন বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরাম। সংগঠনটি গত ১০ বছর যাবত স্তন ক্যানসার সচেতনায় কাজ করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ ফোরাম স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাস (আগস্ট) উপলক্ষে ৩০ দিনব্যাপী বিনামূল্যে স্ক্রিনিংসহ নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, বিশ্বব্যাপী নারীদের মধ্যে শীর্ষস্থানে থাকা, নীরব ঘাতক স্তন ক্যানসার। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১৩ হাজার নারী নতুন করে এই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। মারা যায় প্রায় আট হাজার নারী। অর্থাৎ আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুহার অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কিন্তু এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেসচেতনতার অভাব রয়েছে। বিশেষত নারীদের সংকোচবোধের কারণে দেরিতে চিকিৎসকের কাছে যান। বাংলাদেশে সার্বিকভাবে ক্যানসার নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থাও অপ্রতুল।
স্তন ক্যানসার প্রতিরোধ, প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় ও ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের কোনো জাতীয় কর্মকৌশল, কর্মপরিকল্পনা ও কর্মসূচি নেই বলেও জানান তিনি।
এছাড়া নারী উদ্যোগ কেন্দ্রসহ (নউক) এ ধরনের বিভিন্ন সংগঠনগুলোও নারীদের ক্যানসার নির্ণয় ও সচেতনায় বিভিন্ন সময় নানা কর্মসূচি হাতে নেয়। এর অংশ হিসেবে গত ৭ অক্টোবর নারীদের ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেছে নউক। তাদের এ কর্মসূচির আওতায় জাতীয়, আঞ্চলিক ও সামাজিক পর্যায়ে স্তন ও জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধে জনসচেতনতা, প্রাথমিক অবস্থায় ক্যানসার নির্ণয় ও চিকিৎসাবিষয়ক দিক-নির্দেশনা দেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে কিশোরগঞ্জ জেলার ১৩টি উপজেলায় পর্যায়ক্রমে এই কর্মসূচি চালানো হবে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সামগ্রিকভাবে মানুষকে সচেতন করা না গেলে কোনো কর্মসূচিতেই কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না। তাই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের মাধ্যমে স্তন ক্যানসারের বিষয়ে সামাজিক ট্যাবু ভাঙা ও জনমত গড়ে তোলার পরামর্শ তাদের।
সচেতনতা ও স্ক্রিনিংয়ে এত গুরুত্ব কেন?
জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. নাজিরুম মুবিন ঢাকা মেইলকে বলেন, দেশে স্তন ক্যানসারে আক্রান্তের হার ধীরে ধীরে বাড়ছে। আমাদের দেশ উন্নত হওয়ার দিকে এগিয়ে চলছে। যতই আমরা আধুনিক হবো, আমাদের দেশে স্তন ক্যানসার বাড়তে থাকবে। এর কারণ স্তন ক্যানসারের যে রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো রয়েছে বা যেসব অভ্যাস বা কারণের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে এগুলো আধুনিক জীবনধারার সাথে জড়িত। এটি প্রতিরোধে সচেতনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা স্তন ক্যানসার থেকে একজন মানুষ পুরোপুরি সুস্থ হয়। যে কয়েকটা ক্যানসার চিকিৎসায় বিগত দুই দশকে অভূতপূর্ব সাফল্য পাওয়া গেছে তার মধ্যে একটি স্তন ক্যানসার। এটি একদম অ্যাডভান্স স্টেজেও নিরাময় করা যায়। আর যদি প্রাথমিক পর্যাযে শনাক্ত হয় তাহলে ঝুঁকি বহুলাংশে কমে যায়।
দেশে স্ক্রিনিংয়ের সুযোগ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যানসার শনাক্তের সরকারিভাবে স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। এছাড়া আরও কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এ ক্যানসার নির্ণয়ে স্ক্রিনিং কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। অর্থাৎ যারা একটু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তাদের পরীক্ষা করে ঝুঁকি নির্ণয় করা হয়। যেন ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার আগেই বা প্রথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করে তাদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়।
ডা. নাজিরুম মুবিন বলেন, সরকারি-বেসরকারি নানা মাধ্যম থেকে স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হয়। তবে এখনো আশানুরূপ সচেতনতা তৈরি হয়নি। যারা একটু শিক্ষিত সমাজের অংশ তারা অনেকটাই সচেতন। তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের স্বেচ্ছায় স্ত্রিনিং কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসছে। ফলে শুরুতেই ধরা পড়ছে। কিন্তু যারা কিছুটা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, তারা এ বিষয়টাতে খুব একটা সচেতন না। তারা নিজে থেকে স্ক্রিনিং কর্মসূচির আওতায়ও আসেন না।
এমএইচ/জেবি