বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের আউটডোর সার্জারি বিভাগের ২ নম্বর কক্ষের সামনে হঠাৎ শোরগোল। চিৎকার আর ‘ধর’ ‘ধর’ শব্দে অনেকেই এগিয়ে গেলেন। জড়ো হয়েছেন কয়েকজন আনসার সদস্যও। রোগীদের এমন আচরণের কারণ— ডাক্তারের কক্ষে একের পর এক ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি বা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের প্রবেশ। দাঁড়িয়ে থাকা রোগীরা ত্যক্ত-বিরক্ত ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ভয় দেখাতেই এমন আওয়াজ তুলেছেন। এতে অবশ্য কাজও হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তারের রুমে থাকা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিকে বের হতে দেখা গেল। অপেক্ষমাণ প্রতিনিধিরাও কেটে পড়েন। ফের শুরু হয় রোগী দেখা।
বিএসএমএমইউ হাসপাতালের অন্য যেকোনো বিভাগের তুলনায় সার্জারি বিভাগে রোগীর চাপ কম। নারী-পুরুষ মিলিয়ে এখন ৯ জন রোগী দাঁড়িয়ে। সবার সামনে থাকা অঞ্জলি এসেছেন বৃদ্ধ মাকে নিয়ে। তার মা অসুস্থ হওয়ায় রোগীদের বসার সিটে শুয়ে আছেন। অঞ্জলি জানালেন, ৩৫ মিনিট রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে পাশ কাটিয়ে স্টাফ পরিচয়ে একজন এবং ওষুধ কোম্পানির লোক ঢুকেছে চারজন। তারা ভেতরে গিয়ে আর বের হয় না। ডাক্তারের সাথে গল্প করে, হাসাহাসি করে, যা এখান থেকেও শোনা যায়।
বিজ্ঞাপন
রোগীদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে হাসপাতালের বহির্বিভাগ ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। হাসপাতালটিতে দুই শিফটে রোগী দেখা হয়। এরমধ্যে সকালের টিকিটের মূল্য ৩০ টাকা। বৈকালিক স্পেশালাইজড কনসালটেশন সার্ভিস টিকিটের মূল্য ২০০ টাকা।
সকালে রোগীদের অত্যধিক চাপ থাকে। বহির্বিভাগ ১নং ভবনে বসেন অধিকাংশ বিভাগের চিকিৎসকরা। সকালে তিনটি বিভাগে চিকিৎসকের কক্ষে রোগীর স্বজন পরিচয়ে পরিদর্শন করে দেখা যায়— বহির্বিভাগের ডাক্তারদের চেম্বারে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও কৌশলে রোগী সেজে তারা প্রবেশ করছেন। আর তাদের এই সুযোগ করে দিচ্ছেন কর্তব্যরত আনসার সদস্যসহ ডাক্তারের চেম্বারের সহযোগীরা।
বিজ্ঞাপন
লক্ষ্মীপুর থেকে ছেলের সাথে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন ইসমাইল হোসেন (৮৪)। বার্ধক্যজনিত নানা রোগসহ দীর্ঘদিন কিডনি সমস্যায় ভুগছেন তিনি। লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ অপেক্ষার পর বেলা সাড়ে ১১টায় ডাক্তারের রুমে প্রবেশের সুযোগ পান। তার সাথে রোগীর স্বজন হিসেবে প্রবেশ করেন এই প্রতিবেদক।
ডাক্তার চেম্বারে প্রবেশ করতেই হোঁচট খেতে হয়। দরজা খুলতেই ডাক্তার বললেন, ‘একটু পর আসেন।’ পরে অবশ্য বয়স্ক বিবেচনায় প্রবেশের সুযোগ দেন তারা। এসময় দেখা যায়, চেম্বারে তিনজন ডাক্তার। তাদের সাথে কথা বলছেন আরও ২ জন। তারা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। তিনজন ডাক্তারের মধ্যে ডা. শাহরিয়ার নামে একজন বই পড়ছেন আর গল্প করছেন। বাকি দুজন কখনো নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন, কখনো ওষুধ কোম্পানির লোকদের সাথে কথা বলছেন। একটু পর চেম্বারে প্রবেশ করলেন একটি ব্যাংকের এক প্রতিনিধি, যিনি ক্রেডিট কার্ড সংক্রান্ত সেবা দিতে এসেছেন।
এরইমধ্যে বৃদ্ধ রোগী ইসমাইল হোসেনের চেম্বারে প্রবেশের ৯ মিনিট পার হয়েছে। এ সময় শোনা গেল— ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি দুজন ওষুধের স্যাম্পল দেওয়ার পাশাপাশি ডাক্তারদের ফ্রিজ ও সোফা সেট নেওয়ার কথা বলছিলেন। আলাপ চলছিল ব্রান্ড (ফ্রিজ-সোফা) নিয়ে। একইসাথে ওই ওষুধ কোম্পানির একটি সেমিনারে লাঞ্চের দাওয়াত করছিলেন অনুনয় বিনয় করে।
রুমে প্রবেশের ১৫ মিনিট পর আরও একজন নারী ডাক্তার প্রবেশ করলেন। কুশল বিনিময়ের পর তিনি ওষুধ কোম্পানির এক প্রতিনিধিকে বললেন, খেজুরগুলো ভালো ছিল। আরও দেওয়ার জন্য বললেন। এরপর ডাক্তার ও ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সাথে চলল তার আলাপ। ২৭ মিনিট পর তারা বের হয়ে যান। ডাক্তার রোগী দেখা শুরু করেন।
রোগী দেখার ফাঁকে কিডনি রোগ বিভাগের ডাক্তাররা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলেন—ওরা (একটি ওষুধ কোম্পানি) আগের মতো খোঁজ খবর রাখে না। আমাদের কি ঠেকা পড়েছে? কথা দেবে আর তা রাখবে না, তা তো হয় না। তোমরা আমাদেরটা দেখবে, আমরা তোমাদেরটা দেখব, এই তো।
এসময় ডাক্তারের চেম্বারের সামনে দায়িত্বরত এক কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চেম্বারে রোগী দেখার সময় ওষুধ কোম্পানির লোকদের প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু আমাদের কিছুই করার থাকে না। তাদের ডাক্তারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ। প্রবেশ করতে না দিলে ডাক্তারের কাছে বিচার দেবে। পরে দেখা যায় আমাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেবে।
ওষুধ কোম্পানির লোকদের রোগী সেজে প্রবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কে রোগী আর কে কোম্পানির প্রতিনিধি, সবাইকেই আমরা চিনি। আনসার সদস্যরা আরও বেশি চেনেন। একই লোক প্রতিদিন আসে। এরা (প্রতিনিধিরা) যেভাবে ডাক্তার ম্যানেজ করে, সেভাবে আনসার থেকে শুরু করে সবাইকে ম্যানেজ করতে হয়। কড়াকড়ি দেখালে আমাদেরও গিফট দেয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) আঙিনায় আরেক কোম্পানির এক প্রতিনিধির সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি জানান, বহির্বিভাগে গত ৬ মাসের বেশি সময় কাজ করছেন তিনি। এখানকার স্টাফ থেকে শুরু করে সব আনসার সদস্যই তার পরিচিত।
তিনি জানান, অন্য যেকোনো সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বিএসএমএমইউতে ডাক্তার ভিজিট করা যতটা কঠিন আবার ততটা সহজও। কড়াকড়ি আরোপ করার পর প্রায় সব কোম্পানির লোকেরা রোগীর স্বজন বা রোগী হয়ে প্রবেশ করি। সাধারণ ব্যাগ ব্যবহার করি। আনসার সদস্যদের ম্যানেজ করার পদ্ধতি জানাতে গিয়ে বলেন, আনসার কমান্ডার রয়েছে। তাকে মাসে ৬০ হাজার করে টাকা দিতে হয়। তারা নিজেদের মতো করে ভাগ করে নেয়।
ডাক্তার ম্যানেজ করা প্রসঙ্গে এই প্রতিনিধি বলেন, তাদের কাছে আমরা অসহায়। কিছু থেকে কিছু হলে ওষুধ লেখা বন্ধ করে দেয়। উপহার প্রসঙ্গে জানাতে গিয়ে বলেন, ডাক্তার বুঝে দেওয়া হয়। তবে বেশিরভাগই এখন নগদ নেন। তাদের ব্যাংক একাউন্টে বা আমরা খাম দিয়ে যাই।
এসব বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজাউর রহমানের সাথে কথা বলতে চাইলে তার কার্যালয়ে দীর্ঘ অপেক্ষার সুযোগ মেলে। সবকিছু শুনে তিনি বলেন, এ নিয়ে আমার মন্তব্য করার অনুমতি নেই। যা বলার বলবে মিডিয়া সেল।
এরপর এসব বিষয়ে জানতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের কার্যালয়ে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে হাসপাতালটির জনসংযোগ কর্মকর্তা ও দায়িত্ব প্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তা (অতি. দায়িত্ব) প্রশান্ত কুমার মজুমদার জানান, আজ আর ভিসি স্যারকে পাওয়া যাবে না।
সবশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মিডিয়া সেল প্রধান সমন্বয়ক ডা. এসএম ইয়ার ই মাহবুবের রুমে গেলে তাকেও পাওয়া যায়নি। দায়িত্বরত অফিস সহকারী জানান, ডা. এসএম ইয়ার ই মাহবুবের আজ অফিসে আসার সম্ভাবনা নেই।
ডিএইচডি/জেএম