১৯৫৬ সালে ঢাকায় প্রথম ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিটি মুক্তি পায়। এ ছবিতে শিল্পী আবদুল আলীমের ‘আমি ভিন গেরামের নাইয়া’গানটি শ্রোতাদের ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রূপালি পর্দা ও রেকর্ডের গানের জন্য অসম্ভব খ্যাতি ছিল তাঁর। মঞ্চ, বেতার, টেলিভিশন সব জায়গাতে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত পদচারণা।
পল্লিগীতি গান দিয়ে বাঙালির মন জয় করে নিয়েছিলেন। তাঁর গাওয়া ‘হলুদিয়া পাখি’, ‘রূপালি নদীরে’, ‘কলকল ছলছল নদী করে টলমল’, ‘ভাটির গাঙে ভাইটাল সুরে বাঁশি কে বাজাইয়া যাওরে বন্ধু’, ‘এই যে দুনিয়া কীসের লাগিয়া’, ‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা’-এর মতো জনপ্রিয় গানগুলো এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
বিজ্ঞাপন
১৯৩১ সালের ২৭ শে জুলাই বাংলার মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল আলীম। পিতার নাম ইউসুফ আলি। শৈশবেই আলীম তাঁর পিতাকে হারান। এ অবস্থায় তাঁর মনের কোণে শোকের ছায়া নেমে আসে। এই বিচ্ছেদই তাঁকে সংগীতের দিকে টেনে নিয়েছিল। প্রায়ই গুনগুন করে তিনি গাইতেন।
স্কুলে যখন ভালো লাগত না তখন আলীম চলে আসতেন ভাগীরথী নদীর পাড়ে। নদীর দৃশ্য আর মাঝির কণ্ঠে গান শুনে ভাবতেন, কী করে রেকর্ডে গান করা যায়। কবে কলকাতায় গিয়ে আকাশবাণীতে গান করবেন তিনি। এসব ভাবনা তাঁকে প্রায় সময় আচ্ছন্ন করে রাখত।
পাশের গ্রামে এক বাড়িতে ছিল কলের গান। প্রতিদিন ওই বাড়িতে গিয়ে কলের গানে কে. মল্লিক, আব্বাসউদ্দিন আহমেদ, রঞ্জিত রায়, অনিমা সেনগুপ্তা, পাহাড়ি সান্যাল, যূথিকা রায়, তসের আলীসহ কত-না শিল্পীর গান শুনে শুনে আবদুল আলীম নিজেও ওইভাবে গাইতে চেষ্টা করতেন। মা চাইতেন, ছেলে লেখাপড়া করুক। কিন্তু আলীম লেখাপড়া বাদ দিয়ে গানবাজনায় মশগুল হয়ে পড়লেন। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে আবদুল আলীম নদীর পাড়ে বসে গান গাইতে গাইতে একসময় মঞ্চে তাঁর ডাক পড়ে।
বিজ্ঞাপন
১৯৪২ সালের কথা। মাত্র ১২ বছর বয়সে গুরু সৈয়দ গোলাম আলির হাত ধরে কলকাতায় আসেন তিনি। তাঁর গ্রামের এক আত্মীয় তখনকার কলকাতার মেয়র। তাঁকে গান শোনালেন, গান শুনে সৈয়দ বদরুদ্দোজা তাঁকে কলকাতায় রেখে দিলেন। এরপর বিভিন্ন সভাসমিতিতে তাঁকে গান গাওয়ানোর জন্য নিয়ে যেতে।
একসময় কলকাতার সব আসরে আলীমের উপস্থিতি আবশ্যিক হয়ে উঠল। এভাবে একদিন পরিচয় হয়ে গেল অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হকের সঙ্গে। তাঁর স্নেহ লাভ করলেন আবদুল আলীম।
মোহাম্মদ সুলতানের সহযোগিতায় কাজী নজরুল ইসলামের সুরে প্রথম রেকর্ডে তিনি গাইলেন ‘তোর মোস্তফাকে দে না মাগো সঙ্গে নিয়ে যাই’ এবং ‘আফতাব ওই বসল পাটে আঁধার আইলো শেষে’ গান দুইটি। এর আগে আব্বাসউদ্দিনের গাওয়া ‘উঠুক তুফান মাঝ দরিয়ায়’ গানটি গেয়ে তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে শুনিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগাভাগি হলে আবদুল আলীম কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। এরপর ঢাকা বেতার কেন্দ্রে নিয়মিত পল্লিগীতি পরিবেশন করতে থাকেন। ১৯৫২ সালের বঙ্গ সংগীত সম্মেলনের লাহোর অধিবেশনে আলীমের যোগদান করার সৌভাগ্য হয়। সেখানে পল্লিগীতি গেয়ে তিনি দারুণ প্রশংসা অর্জন করেন।
১৯৫৬ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ৫০টি ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আবদুল আলীম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো - মুখ ও মুখোশ, এদেশ তোমার আমার, জোয়ার এলো, সুতরাং, নদী ও নারী, কাগজের নৌকা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, সাতভাই চম্পা, স্বর্ণকমল, গাঁয়ের বধূ, লালন ফকির, দস্যুরানি, উৎসর্গ, তীর ভাঙা ঢেউ। এসব ছবিতে শিল্পীর গাওয়া গান এখনও শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে।
আজ রোববার আবদুল আলীম ৯৪তম জন্মবার্ষিকী। আজ তিনি বেঁচে নেই, তবে বেঁচে তাঁর সৃষ্টিকর্ম। তাঁর গান এ প্রজন্মের শিল্পীরাও বিভিন্ন চ্যানেলে গেয়ে বাহবা পাচ্ছেন। অসংখ্য ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদি, ইসলামি আর লোকসংগীতের মাধ্যমে আবদুল আলীম অমর হয়ে থাকবেন।

