বাংলা লোকগানের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন শিল্পী আবদুল আলীম। তার কণ্ঠের মাধুর্যে লোকসংগীত পৌঁছে গেছে অন্য উচ্চতায়। তার গানে জীবন, জগৎ ও ভাববাদী চিন্তা একাকার হয়ে যায়। মরমী এই শিল্পীর জন্ম ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। আজ তার ৯১তম জন্মবার্ষিকী।
পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন ঢাকা সংগীত কলেজের লোকগীতি বিভাগের অধ্যাপক। কৈশোরেই গায়ক হিসেবে নাম করেছিলেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তার গানের প্রথম রেকর্ড হয়। রেকর্ড করা গান দুটি হলো ‘তোর মোস্তফাকে দে না মাগো’ ও ‘আফতাব আলী বসল পথে’। এত অল্প বয়সে গান রেকর্ড হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। অবশ্য পরে তা আর বিস্ময় হয়ে থাকেনি, তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার লোকসংগীতের প্রথিতযশা শিল্পী।
বিজ্ঞাপন
তবে অর্থনৈতিক অনটনের কারণে কোনো শিক্ষকের কাছে গান শেখার সুযোগ পাননি আবদুল আলীম। অন্যের গান শুনে শুনে তিনি শিখতেন আর বিভিন্ন পার্বণে সেগুলো গাইতেন।
১৯৪২ সালে উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় গিয়েছিলেন। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বড় ভাই শেখ হাবিব আলী আব্দুল আলীমকে নিয়ে গান পরিবেশনের সুযোগ পেলেন।
বাংলার প্রধানমন্ত্রীর সামনে গান গাওয়ার সুযোগ পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ধীর পায়ে মঞ্চে উঠে ‘সদা মন চাহে মদিনা যাব’ গানটি গাইলেন। মঞ্চে বসে আবদুল আলীমের গান শুনে শেরে বাংলা শিশুর মতো কেঁদে ফেললেন। কিশোর আলীমকে জড়িয়ে নিলেন তার বুকে। উৎসাহ দিলেন, দোয়া করলেন এবং তখনই বাজারে গিয়ে পায়জামা, পাঞ্জাবী, জুতা, পুটি, মোজা কিনে দেন। পরবর্তীকালে তার গানে আপ্লুত হয়নি এমন লোক বিরল।
দেশভাগের পরে আবদুল আলীম ঢাকায় চলে আসেন এবং রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন। টেলিভিশন সেন্টার চালু হলে সেখানেও তিনি সংগীত পরিবেশন শুরু করেন। এ ছাড়া তৎকালীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’সহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে আবদুল আলীম গান করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের নাম ‘লালন ফকির’।
বিজ্ঞাপন
আবদুল আলীম বাংলাদেশ টেলিভিশন ও রেডিও ছাড়া দেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। শিল্পীর ৫০০ গান রেকর্ড হয়েছে, এ ছাড়া স্টুডিও রেকর্ডেও রয়েছে অসংখ্য গান।
পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদী, ইসলামী আর এসব গানের শিল্পী হিসেবে আজও তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কণ্ঠস্বরের অসাধারণ ঐশ্বর্য নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন।
যাদুকরী কণ্ঠের অধিকারী আব্দুল আলীম জীবদ্দশায় ও মরণোত্তর বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একুশে পদক, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।
পাকিস্তান মিউজিক কনফারেন্স, লাহোরে সঙ্গীত পরিবেশন করে আব্দুল আলীম পাঁচটি স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে।
কালজয়ী শিল্পী আবদুল আলীম ১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ভক্তকুলকে কাঁদিয়ে পিজি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৪৩ বছর।
আরএসও

