শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

আধুনিক গানের সুর স্রষ্টা কমল দাশগুপ্ত

বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ জুলাই ২০২৫, ০৬:৩২ পিএম

শেয়ার করুন:

আধুনিক গানের সুর স্রষ্টা কমল দাশগুপ্ত

কাজী নজরুল ইসলামের পর যদি বাংলা গানের বাণিজ্যিক গানের সাফল্যের খতিয়ান নেওয়া হয় তাহলে সবার প্রথমে আসা উচিৎ কমল দাশগুপ্তর নাম। সে যুগে হিট আধুনিক গানের সুরকার বললেই বোঝাতো কমল দাশগুপ্ত। প্রখ্যাত এ সুরকার ‘এইচএমভি’ কত ব্যবসা সফল গান উপহার দিয়েছেন তার হিসাব করা দুঃসাধ্য। 

তবে কমল দাশগুপ্তের কাজের কথা বেশি দিন মনে রাখেননি তখনকার বিদেশী সাহেব। কমল অসুস্থতার কারণে কাজ করতে পারছিলেন না। তখনই ‘এই এইচ এম ভি’ এ সুরকারের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে এতটুকু কুন্ঠাবোধ করেনি। 


বিজ্ঞাপন


 ‘শেষ উত্তর’, ‘যোগাযোগ’ ,‘গরমিল’ ,‘নন্দিতা’ ,‘জবার’-এর কমল দাশগুপ্ত আমার কাছে ছিল স্বপ্ন। আমি আনন্দে তুলে নিলাম কলম। তখন কমলদা আর্থিক দুরাবস্থায়। গানের সিটিং এর তেমন কোনো জায়গা নেই। আগের দিনের প্রকৃত স্রষ্টা শিল্পী কমলদা  চিরদিনই ‘এইচ এম ভি’তে ওঁর নির্দ্দষ্ট ঘরে সুরসাধনা নিয়ে থাকতেন। এবারও তাই চাইলেন। তার ব্যবস্থাও হলো। কিন্তু কমলদা কিছুতেই চারটে-সাড়ে চারটার আগে ওখানে আসতে পারতেন না। তখন ঠিক পাঁচটায় সাহেবি কায়দায় তখনকার ‘এইচ এম ভি’-এর দরজা বন্ধ হয়। হয়তো  ওঁদের স্বর্ণ সময়ে ওঁর জন্য কোনো সময়ের বিধিনিষেধ থাকতো না। 

সেই অভ্যাসের কমলদা দেরি করে এসে গান নিয়ে বসতেন। ঘড়ির কাঁটায় হারমোনিয়াম ছেড়ে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এসে বসতেন। ‘এইচ এম ভি’-এর অফিসের সদর দরজার পাশের বারান্দায় হারমোনিয়াম নেই। সন্ধ্যা হয়ে আসত তেমন আলোও পেতেন না। শুধু আমার গানের কাগজটা চোখের সামনে তুলে ধরে মনে মনে সুর করতেন। আর গানের পঙতির মাথায় লিখে রাখতেন শর্টহ্যান্ড স্বরলিপি। আমার চোখ ফেটে জল আসতো। যতক্ষণ না উনি বলতেন- চলরে পুলক। ততক্ষণ আমি বসে থাকতাম।

তখন কমলদা বিয়ে করেছেন। ফিরোজা বউদিকে (বিখ্যাত শিল্পী ফিরোজা বেগম) নিয়ে থাকতেন হেদুয়া অঞ্চলে। ওখানেই একদিন দূঃখ করে আমাকে বললেন- রেকর্ড দুটো তেমন চললো না রে! বললাম- কীভাবে চলবে বলুন? ওইভাবে কি গান হয়? বললেন- তুই আসিস। তোর গান সুর করে রাখবো। মাঝে মাঝে যেতাম। রেকর্ড না হওয়া সেসব অনেক গানেরই উল্লেখ করেছিলেন সেদিন ফিরোজা ভাবি।


বিজ্ঞাপন


আধুনিকা ছবির সময়কার একটা ঘটনায় শ্রদ্ধেয় কমলদার উপদেশ আমি আজও মেনে চলি। অসিম কুমার আর অনিতা গূহ অভিনীত ‘আধুনিক’ ছবির গান রেকডিং আগে কোলকাতায় কমলদার বোনের বাসায় খাওয়া শেষে তিনি হেসে বললেন- পুলক এ কি লিখেছিস? একি তোর লেখা? এ গান যখন রেকর্ড হয়ে বের হবে তখন কেউ কি জানবে ‘আধুনিকার’ প্রযোজক তোকে ঠকিয়েছে?

বাড়তি পয়সা না দিয়ে কাজ করিয়েছে? সবাই বলবে যা- তা লিখেছে পুলক। এমন ধরনের কন্ট্রাক্ট আর কখনও সই করিসনি। কিন্তু এবার যখন করেছিস তোকে যারা ভালোবাসে তাদের ঠকাস না। এ জগতে ভালো কাজটাই সব। পয়সা পাওয়াটা সব নয়।

518788717_5057846237772992_1172925514429432403_n

কমলদার কথায় এক আলো ঝলমলে নতুন দিগন্ত পেলাম। এ কথা শোনার পর ওঁকে আর প্রণাম না করে থাকতে পারিনি। বুঝলাম এই নিষ্ঠার জন্যই উনি সেই দম্পত্তি’ আলেয়া’ চন্দ্রশেখর’ ইত্যাদি দিয়ে পরের পর ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন।

কমলদা বললেন- জানিস আমরা যখন রেকর্ডে ঢুকেছি তখন প্রতি টাইটেল প্রতি সাহেব কোম্পানী আমাদের পাঁচ টাকা করে দিত। আমার ঘাড়ে বিরাট সংসারের দায়িত্ব। সারাদিন অন্তত চারটে টাইটেল না করে বাড়ী ফিরতে পারতাম না। সংসার চালাতে হবে তো? এইচ এমভি, কলম্বিয়া তো ছিলই- ওদের ‘টুইন’ লেবেলেও দিনের পর দিন কাজ করে গেছি। কিন্তু বিশ্বাস কর কোনোদিন কাজে ফাঁকি দিয়ে নিজেকে ঠকাইনি। আমার চোখে জল চলে এসে গিয়েছিল। ও গান দুইটি ছিঁড়ে ফেলে নতুন করে দুটো গান লিখলাম।

সে দুটোই রেকর্ড হলো ‘আধুনিকা’ ছবিতে। আলপনা গাইল গান দুটো! পরপর ব্যাংক ফেল হওয়ায় সর্বস্ব খুইয়ে যখন এ হেন মানুষ দিন কাটাচ্ছেন কেউ এগিয়ে আসেননি ওঁর কাছে। হিন্দি ‘জবাব’ চন্দ্রশেখর’কৃষ্ণলীলা’র পর শুনেছি মুম্বাইয়ে গিয়ে হিন্দি ছবি করার জন্য এক প্রযোজক ব্ল্যাংক চেকও ওঁর দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন।
কমলদা সেই বিনীত হাসি হেসে বলেছিলেন—কলকাতায় রেকর্ড করলে করব। বিদেশে যেতে পারব না। কেন, এখান থেকে কি নিউ থিয়েটার্সের হিন্দি গান হিট হয়নি? কলকাতা ছাড়েননি কমলদা।

সেই কমল দাশগুপ্তই জীবণধারনের জন্য চলে গেলেন বাংলাদেশ ঢাকায়। স্ত্রী ফিরোজা বেগম পরম যত্নে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কমলদার পাশে ছিলেন।
এতবড় সুরকারের নি:শব্দে ওপার বাংলা চলে যাওয়া কোনোও বিখ্যাত পত্রিকায় এক পঙতিও সংবাদ হলো না।

তথ্যসূত্র- পুলক বন্ধ্যোপাধ্যায়-এর ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’ বই। 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর