রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ইরানি কবি শেখ সাদি কেন এত বিখ্যাত?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৯ জুন ২০২৫, ০৪:১০ পিএম

শেয়ার করুন:

ইরানি কবি শেখ সাদি কেন এত বিখ্যাত?

ইরানি সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে শেখ সাদি (Sheikh Saadi) এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছেন। ১২ ও ১৩ শতকে জন্ম নেওয়া এই মহান কবি, দার্শনিক ও নৈতিক শিক্ষাবিদ তার সাহিত্যকর্ম, মানবিক মূল্যবোধ ও দর্শনের গভীরতার কারণে আজও বিশ্বজুড়ে পাঠক ও গবেষকদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। তাঁর লেখা কেবল পারস্য বা ইসলামিক দুনিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি সারাবিশ্বে মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চিন্তার এক পথপ্রদর্শক।

অসাধারণ সাহিত্যকর্মের মহারথী

শেখ সাদির সবচেয়ে পরিচিত দুই গ্রন্থ—গুলিস্তাঁ ও বুস্তাঁ। এর গল্প ও নৈতিক শিক্ষা, যেখানে ছোট ছোট বাণী ও গল্পের মাধ্যমে জীবন, ন্যায়বিচার, প্রেম, ধৈর্য ও মানবিক গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে। বুস্তাঁ কবিতা চরিত্র গঠন ও আধ্যাত্মিকতার ওপর লেখা, যেখানে ধৈর্য, দয়া, সততা ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রশংসা করা হয়েছে। এই দুই গ্রন্থে সাদি মানব জীবনের নানা দিক শিল্পময় ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন, যা যুগে যুগে পাঠকদের হৃদয়ে আলোকস্তম্ভ হিসেবে জ্বলজ্বল করছে।

মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রকাশ

তাঁর সাহিত্য শুধু রূপকথা নয়, জীবনের মৌলিক নৈতিক শিক্ষা বহন করে। সহমর্মিতা, দয়া, সত্যনিষ্ঠা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও বাস্তব জীবনের জ্ঞান তাঁর লেখার মূল ভিত্তি। এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে ইসলামিক বিশ্ব ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।

ভাষা ও সহজবোধ্যতা

পারস্য ভাষায় সরল, প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় লেখা তাঁর কাব্য বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্বের পাঠকদের কাছে পৌঁছেছে এবং বিশ্বসাহিত্যের অমর অংশে পরিণত হয়েছে।

আরও পড়ুন: ইরান কেন ইসলামের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে?

বিশ্বজনীনতা ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

তাঁর শিক্ষা সীমাবদ্ধ নয়, বরং সারাবিশ্বের মানুষের জন্য সার্বজনীন। ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্য-দর্শনে সাদির গভীর প্রভাব রয়েছে। বহু বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক তাঁর কাজ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।

ঐতিহাসিক ভ্রমণ ও জীবনের অভিজ্ঞতা

দীর্ঘকাল দেশে দেশে ভ্রমণের মধ্য দিয়ে সাদি বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন। এই অভিজ্ঞতাগুলো তাঁর লেখায় বৈচিত্র্য ও গভীরতা আনে, যা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে।

বালাগাল উলা'র রচয়িতা

শেখ সাদের লেখা একটি বিখ্যাত নাত- “বালাগাল-উলা বিকামালিহি, কাশাফাদ দুজা বিজামালিহি, হাসুনাত জামিউ খেসালিহি, সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি।” বলা হয়ে থাকে, তিন দিন তিন রাত এই নাতের চতুর্থ চরণ রচনা করতে না পারায় তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। একদিন স্বপ্নে নবী মুহাম্মদ (স.)-কে দেখেন। নবী (স.) তাঁকে চতুর্থ চরণ হিসেবে ‘সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি’ বলে দেন। (তথ্যসূত্র: অগ্রপথিক ই.ফা.বা.)

জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষা

শেখ সাদি ১১৭৫ খ্রিস্টাব্দে (৫৭৫ হিজরি) পারস্যের সিরাজনগর জেলার তাউসে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সিরাজেই সম্পন্ন করে উচ্চশিক্ষার জন্য বাগদাদে যান। অল্প সময়েই তিনি কোরআন, হাদিস, তাফসির, ফিকাহ, দর্শন, ভাষাবিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন এবং ‘মাওলানা’ উপাধি লাভ করেন। এছাড়া সুফি সাধক আবদুল কাদির জিলানির সান্নিধ্যে আধ্যাত্মিক জ্ঞান গ্রহণ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি ২৪টির বেশি ভাষা শিখে ফেলেন, যার মধ্যে আরবি, ফার্সি, হিব্রু, গ্রিক, তুর্কি, ল্যাটিন, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত অন্যতম।

আরও পড়ুন: ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ নিয়ে হাদিসে কী আছে

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ

মোট ২২-২৪টি গ্রন্থের মধ্যে প্রধান গ্রন্থগুলো হলো- গুলিস্তান, বুস্তান, সাহারিয়া, কারিমা, কাসায়েদ ফারসি, কাসায়েদ আরবিয়া, গজলিয়াত, পান্দে নামাহ ইত্যাদি।
এই গ্রন্থগুলোতে নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা, কবিতা ও দর্শনের গভীর আলোচনা ও চমৎকার রচনা রয়েছে।

শেখ সাদির লেখার ওপর গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ

বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাঁর সাহিত্য ও দর্শনের ওপর গবেষণা চলছে, যেমন— হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় (ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউট), তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় (SOAS)। শুধু সাহিত্য নয়, তাঁর দর্শন ও নৈতিক শিক্ষার আধুনিক প্রাসঙ্গিকতাও এখানে বিশ্লেষণ করা হয়।

আরও পড়ুন: যেসব মুসলিম মনীষীর জন্ম ফিলিস্তিনে

জীবনদর্শন ও প্রখ্যাত বাণী

শেখ সাদি জীবনের বাস্তবতা ও আধ্যাত্মিকতার ওপর দৃষ্টান্তমূলক বাণী রেখেছেন—

জীবনোপলব্ধি
“সারা রাত কাটে ইবাদত বন্দেগিতে,
ভোররাত কাটে রিযিকের দোয়া-মুনাজাতে,
আর সারা দিন যায়—রুটি-রুজির ধান্ধায়।”

সাংসারিক বাস্তবতা
“পরিবারের শেকলে বাঁধা তুমি সকাল-বিকাল,
ঝেড়ে ফেলো নিশ্চিন্তে ইবাদতের খোশ-খেয়াল।”

আধ্যাত্মিকতার অন্তরায়
“হাত পেতে নিলো যে দিরহাম-দিনার,
নিজেই গুঁড়িয়ে দিলো সে সাধুতার মিনার।”

শাসকের কর্তব্য
“বাদশাহ হলেন জনগণের রাখাল;
যদিও প্রচুর ধন-সম্পদ তার,
রাখলের জন্য নয় ছাগল,
ছাগলের সেবা করার জন্যই রাখাল।”

মানবজীবনের অনিত্যতা
“বহু নামকরা মানুষ মাটির নিচে দাফন,
যাদের কোনো নাম-নিশানাও নেই পৃথিবীতে।”

নিরুপায়দের প্রতি সহানুভূতি
“যদি দেখি অন্ধ ও কূপ,
খুবই অন্যায়, যদি থাকি বসে করিয়া চুপ।”

সঠিক পথের নির্দেশ
“হে বেদুঈন,
আমি শংকিত, তুমি পারবে না পৌঁছতে কাবাতে;
কারণ যে পথে তুমি গমন করেছ,
সে পথ যাবে তুর্কিস্তানে।”

বিশ্বভ্রমণ ও পরবর্তী জীবন

শিক্ষাশেষে হজ পালনের পর দামেস্ক, জেরুজালেম, কায়রো, ভারত, সমরকন্দ, চীন, স্পেন, ইতালি ও আফ্রিকা ভ্রমণ করেন। তাঁর জীবনভ্রমণ কবিতায় তুলে ধরেছেন— “নানান দেশে ঘুরে ঘুরে জীবন হল গত যে, নানান রকম লোকের সাথে দিন কেটেছে কত যে। যেথায় গেছি কিছু নিয়েছি মোর থলিতে, নিয়েছি ভালো যা পেয়েছি পথের ধারে চলিতে।”

জীবনের শেষ পর্যায়ে হামদ, নাত, গজল ও উপদেশমূলক রচনা লিখতেন তিনি এবং রাতে কোরআন পাঠ ও ইবাদত করতেন।

শেষ জীবন ও উত্তরাধিকার

শেখ সাদি জীবনকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন—৩০ বছর অধ্যয়ন, ৩০ বছর ভ্রমণ ও কাব্য রচনা এবং ৩০ বছর ধ্যান-আরাধনা ও শিক্ষাদানে ব্যয় করেছেন। তিনি ১২৯২ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন এবং সিরাজনগরের ‘দিলকুশা’তে দাফন হন।

শেখ সাদি তাঁর সাহিত্য ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে মানব জীবনের গভীর দিক সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করে যুগে যুগে মানুষকে প্রেরণা দিয়েছেন। তাঁর নাম পারস্য সাহিত্যের আকাশে এক উজ্জ্বল তারা, যা আজও আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার উৎস।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর