রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

আমাকে যত মন্দ মনে কর তত মন্দ নই, নার্গিসকে বলেছিলেন নজরুল

বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৬ মে ২০২৫, ০৪:০৪ পিএম

শেয়ার করুন:

আমাকে যত মন্দ মনে কর তত মন্দ নই, নার্গিসকে বলেছিলেন নজরুল

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনে যে কয়জন নারী এসেছেন তাদের মধ্যে দুইজন নারীর উপস্থিতি খুব গভীর ভাবে লক্ষ্য করা যায়। একজন নার্গিস। আরেকজন হলেন প্রমীলা। কবির হৃদয়ের দুই সারথী। একজন চাঁদ তো অন্যজন নীল সরোবর। 

নার্গিসের সঙ্গে কবির বিয়ের কথা ছিল কিন্তু বিয়ের আসর থেকেই পালিয়ে গিয়েছিলেন কাজী নজরুল। এর কয়েক দিন পর কবির উদ্দেশে চিঠি লেখেন নার্গিস। সেই চিঠির উত্তর নজরুল দিয়েছিলেন একটি গানের মাধ্যমে- “যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখ তারে্। ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।”


বিজ্ঞাপন


কাজী নজরুলের ইসলামের নাতি কাজী অনির্বাণ আর নেই

তবে নজরুল কি সত্যিই ভুলতে পেরেছিলেন নার্গিসকে? পনেরো বছর পর একটি আবেগময় চিঠি লিখেন নার্গিসের কাছে- যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। চিঠিটি বিশ্বের সেরা প্রেমপত্রের একটি। এই চিঠিতেই ভালোবাসার শাশ্বত রূপ ফুটে উঠেছে। নিচে চিঠিটি উল্লেখ করা হলো। 

কল্যানীয়াসু,

তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নববর্ষের নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল ।পনেরো বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে, এমনি এক বারি ধারায় প্লাবন নেমেছিল। তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পার। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার । এই মেঘদূত বিরোহী যক্ষের বানী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তার প্রিয়ার কাছে। 


বিজ্ঞাপন


Sharebiz.Net-National-Poet-Kazi-Nazrul-Islam_Birth-Anniversary-2-883x940

এই মেঘ পুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চার। এই আষাঢ় আমায় কল্পনার স্বর্গ লোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে। যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দেই। তুমি বিশ্বাস কর, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখে শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাক,তাহলে আমায় ভুল বুঝবে। আর তা মিথ্যা।

অবশেষে জাতীয় কবির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন কাজী নজরুল

তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করিনা। আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কী গভীর ক্ষত, কী আসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি। তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি । তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না। 

আমি ‘ধুমকেতু’র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যান রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম। যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার আঞ্জলি দিয়েছিলাম। সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত। মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের সে আগুন- বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি।

কাজী নজরুল ইসলামের বায়োপিক, কবির স্ত্রীর চরিত্রে স্পর্শিয়া

তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি। আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয়। আমার আঘাত বর্বরের কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার বিরুদ্ধে আজও কোনো দাবী, অনুযোগ, অভিযোগ নেই । 

তোমার আজিকার রূপ কি জানিনা, আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মুর্তিকে। যাকে দেবী মূর্তির মতো আমার হৃদয় বেদীতে অনন্ত প্রেম, অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম । সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলে না । পাষান দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদিপাঠ। জীবন সেখানেই চলেছে আমার পূজা আরতি । আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা,ব্যর্থ ; তাই তাকে পেতে চাই না। জানি না হয়তো সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব, অধিকতর বেদনা পাব। তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি। দেখা? না-ই হলো। এ ধূলির ধরায় প্রেমের ফুল ধূলিতলে হয়ে যায় ম্লান, দগদ্ধ, হতশ্রী।

nazrul-islam-2-inner-2405241824

তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালোবাস আমাকে চাও ওখান থেকেই আমাকে পাবে। লাইলি মজনুকে পায়নি। শিরি ফরহাদকে পায়নি। তবু তাদের মত করে কেউ কারও প্রিয়তমাকে পায়নি। আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও প্রেম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাক তাহলে তোমার মতো ভাগ্যবতী আর কে আছে? 

শেরপুরে কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী পালিত

তার মায়া স্পর্শে তোমার সকল কিছু আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে। দুঃখ নিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই সেই দুঃখের অবসান হয় না। মানুষ ইচ্ছা করলে সাধনা দিয়ে তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুল রূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে। জীবনে যদি কোনো ভুল করে থাক। এই জীবনেই তাকে সংশোধন করে যেতে হবে। তবেই পাবে আনন্দ মুক্তি। তবেই হবে সর্ব দুঃখের অবসান। নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা কর, স্বয়ংবিধাতা তোমার সহায় হবেন। 

আমি সংসার করছি। তবু চলে গেছি এই সংসারের বাধাকে অতক্রম করে উর্ধ্ব লোকে। সেখানে গেলে পৃ্থিবীর সকল অপূর্ণতা, সকল অপরাধ ক্ষমা সুন্দর চোখে পরম মনোহর মূর্তিতে দেখা যায় । হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনেরো বছর আগের কথা। তোমার জ্বর হয়েছিল। বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল। তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজও অনুভব করতে পারি। 

prothomalo_import_media_2016_05_25_934442cccb72a3054085553262c70adc-17-ezgif.com-avif-to-jpg-converter

তুমি কি চিয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিল জল। হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা। অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুন মিনতি। মনে হয় যেন কালকের কথা। মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারল না। কী উদগ্র অতৃপ্তি। কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল। সারাদিন রাত আমার চোখে ঘুম ছিল না। 

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী আজ

যাক আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষে রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে। তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করো না। তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি বিশ্বাস করো আমার অক্ষয় আশির্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে। তুমি সুখি হও, শান্তি পাও— এই প্রার্থনা। আমাকে যত মন্দ বলে বিশ্বাস কর, আমি তত মন্দ নই। এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ।  

কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। আর নার্গিস চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ম্যানচেস্টার (ইংল্যান্ড) শহরে।
 
ইএইচ/

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর