সৌদি আরবে খেজুর গাছের অভাব নেই। খেজুর গাছই এই দেশের নিদর্শন। সেজন্য দেশটির যেকোনো নান্দনিকতায় খেজুর গাছের চিহ্ন দেখা যায়।
জেদ্দার যে হোটেলে উঠেছি সেখান থেকে অনুষ্ঠানের মূল ভেন্যু রিটজ-কার্লটন আধা কিলোমিটারের মধ্যে। তবে অনুষ্ঠানের আরেকটি পার্ট ২০ কিলোমিটার দূরের রেড সি মলে। রোববার সেখানে হলিউড অভিনেতা জনি ডেপের আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে টিকিট করে রেখেছিলাম। কিন্তু দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে কাছাকাছি পৌঁছানোর পর জানতে পারলাম জনি ডেপ হঠাৎ করে কনভারসেশন প্রোগ্রাম বাতিল করেছেন। মনটা খারাপ হয়ে যাওয়ার পর আকস্মিকভাবে একটি সুখবরও পেলাম।
বিজ্ঞাপন
জেদ্দায় জার্মানি কনস্যুলেট অফিস থেকে সিনেমার কলাকুশলীদের সঙ্গে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিককে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। যেখানে আমার নামটিও আছে। হোয়াটসআপ ম্যাসেজে জানিয়েছেন আমিরা। তিনি জেদ্দার কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটির মিডিয়া অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। রেড সিতে আমন্ত্রিতদের সুযোগ-সুবিধার দিকটি দেখাশোনা করেন। তিনি বললেন, এক ঘণ্টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছাতে হবে পাসপোর্টসহ। সেখানে থেকে দূতাবাসের গাড়ি নিয়ে যাবে। হোটেল লবিতে পৌঁছার পর পাসপোর্ট চেক করে জানানো হলো, গন্তব্য আল মোহাম্মদীয়া এলাকায়। ওখানকার ১৫২ মারওয়ান বিন আবদুল রহমান রোডের ৬০ নম্বর বিল্ডিংয়ে পৌঁছাতে সময় লাগলো ২৩ মিনিট। নিরাপত্তা তল্লাশি শেষ করে গেলাম কনসাল জেনারেলের বাসভনের বাগানে।
এই বাগানের সৌন্দর্য্য বর্ধন করা হয়েছে কয়েকটি খেজুর গাছ কেন্দ্র করে। যেখানে জার্মানির বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ছবিও রাখা হয়েছে। ভেতরে প্রবেশ করতেই ম্যাক্সি পরিহিত এক নারী এগিয়ে আসলেন। সৌদি আরব কেমন লাগছে, পথে কোনো কষ্ট হয়েছে কি না— নানা বিষয়ে প্রশ্ন করে পার্টি এনজয়ের আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেলেন খাবার পরিবেশনকারীদের কাছে। খাবারের দায়িত্বে রয়েছেন স্থানীয় শেরাটন হোটেলের শেফরা। পরিবেশনকারীদের সবাই বাংলাদেশি। এখানে আরেকটা বিষয় অদ্ভুত লেগেছে। আমন্ত্রিতদের বসার জন্য কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। টেবিলগুলো উচুঁ উচুঁ। দাঁড়িয়েই খেতে হবে।
এক পরিবেশনকারীর কাছে আমি বাংলাদেশি পরিচয় দেওয়ার পর তিনি মনে হয় একটু বিব্রত হয়ে গেলেন। আমি যেখানে ছিলাম পরে আর ওনাকে সেদিকে দেখা যায়নি। বোঝা গেলো যে উনি যে দায়িত্বে আছেন সেটাকে তিনি সম্মানজনক ভাবতে পারেনি। তাই অন্যদের সঙ্গে আর ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করিনি। কাউকে বিব্রত করা আমার লক্ষ্য না। তাই প্রথম যে নারী আমাকে আন্তরিকতার সাথে স্বাগতম জানিয়েছেন ওনার সঙ্গে আবার কথা বলার চেষ্টা করি। তার নাম ড. এলটজে অ্যাডেরহোল্ড। উনি জার্মানির কনসাল জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিছুটা হতচকিত হলাম, কারণ যিনি এখানে সর্বোচ্চ পদে রয়েছেন তিনি এতো সাদামাটাভাবে সবার সঙ্গে মিলেমিশে কথা বলছেন, এটা সত্যিই অতুলনীয়। বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক খোঁজখবর রাখেন তিনি। রাজনীতি, অর্থনীতি ওনার পাণ্ডিত্য দেখে অবাক হতে হয়েছে বারবার। আমাদের দেশে গার্মেন্টস শ্রমিকরা আন্দোলন করছে বেতন বৃদ্ধির জন্য— এটাও তিনি জানেন। প্রসঙ্গ অন্যদিকে নিতে ড. এলটজের জার্মানির পররাষ্ট্র দফতরে যুক্ত হওয়ার ইতিহাসটা জানতে চাইলাম।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, আমি আইনের ছাত্রী ছিলাম। ১৯৯১ সালে ‘বন বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে আইন বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছি। এরপর ১৯৯২ সালে জার্মানির পররাষ্ট্র বিভাগে যোগ দিয়েছি। এরপর হ্যানয় ও কাবুলে জার্মান মিশনে ছিলাম, জেনেভায় জাতিসংঘ এবং ভিয়েনায় অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থায় বিভিন্ন পদে কাজ করেছি। জার্মানির ফেডারেল পার্লামেন্টে (বুন্ডেস্ট্যাগ) আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমন্বয়কারী হিসেবেও কাজ করেছি। তখন বাংলাদেশ নিয়েও কিছু পড়াশোনা করেছি।
২০২০ সালে জেদ্দায় আসার আগে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে জার্মানির কনসাল জেনারেল হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
আমার সঙ্গে আলোচনা শেষ করে আমন্ত্রিত সবাইকে জড়ো করলেন। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে প্রথমে পার্টিতে কি কি আয়োজন থাকছে সেটা বলার জন্য জেদ্দা শেরাটনের জেনারেল ম্যানেজারকে ডাকলেন। এরপর আবার মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তিনি বললেন, সৌদি আরবের অগ্রযাত্রায় জার্মানি বেশকিছু প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। বিশেষ করে ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়নে মূল্যবান কিছু প্রকল্পের অংশীদার হতে পেরে আমরা খুবই গর্বিত।
ওই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক, নির্মাতা, বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু ড. এলটজে অ্যাডেরহোল্ডের আচরণ মনে থাকবে আজীবন। কারণ বিদায় নেওয়ার সময় তিনি সবার সামনে নাম ধরে বললেন, নাইস টু মিট ইউ আলমগীর। আমি একবার মাত্র নিজের নামটা বলেছি। কিন্তু তারপরও এতগুলো মানুষের মাঝে আমার নামটা কিভাবে তিনি মনে রাখলেন সেটা আমার কাছে ধাঁধার মতো মনে হচ্ছে এখনো। হয়তো সারাজীবনই এটা ধাঁধা হয়ে থাকবে।