রাজধানীর রাজাবাজার এলাকায় মেসে উঠেছেন সামিয়া রহমানসহ আট বান্ধবী। সবাই একই কলেজের শিক্ষার্থী। এসেছেন দিনাজপুর থেকে। সামিয়া বলেন, বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি। ছোটবেলা থেকে কোনোদিন একা ছাড়েনি। কিন্তু এইচএসসি পাসের পর একাই ঢাকায় থাকছি। বলা যায়, জীবনে প্রথম স্বাধীনতা পাচ্ছি। পড়ালেখা নিয়েই ব্যস্ত আছি। তিনি আরও বলেন, আব্বু আসার সময় বলে দিয়েছে, একা ঢাকায় থাকবা, কেউ দেখবে না কি করছ। কিন্তু এই কটা মাস যদি কষ্ট কর তবে পুরো ভার্সিটি লাইফ স্বাধীনভাবে থাকতে পারবা।
সামিয়া বলেন, এখানে যে খাবার খাচ্ছি তা বাড়িতে হলে মুখেও নিতাম না। এখন প্রায়ই বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে খাই। অনেক কষ্ট হলেও মুখ বুজে সহ্য করছি।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর ফার্মগেট ও এর আশপাশের এলাকায় সামিয়ার মতো এমন শিক্ষার্থীদের ব্যাপক ভিড়। হাজার হাজার শিক্ষার্থী সময় পার করছেন উচ্চ শিক্ষায় পছন্দের প্রতিষ্ঠানে, পছন্দের বিষয়ে পড়ার সুযোগের আশায়। তারা সবাই এসেছেন ঢাকায় কোচিং করতে। সেই সাথে কোনো মেসেই এখন ফাঁকা নেই সিট৷ অনেক বাড়িওয়ালাও কয়েক মাসের জন্য ছেড়ে ভাড়া দিয়েছেন এক রুম।
সাব্বির হাসান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রথমবার ঢাকায় এসেছি। বন্ধুদের সাথে একা থাকছি। মজা যেমন লাগছে, সেই সাথে একটা চ্যালেঞ্জ। কোনো একটা পাবলিক ভার্সিটিতে সুযোগ পেতেই হবে।
পান্থপথ এলাকায় মায়ের সাথে এক রুম নিয়ে থাকেন মালিহা নক্ষত্র। তিনি বলেন, শুরুতে একাই একটা হোস্টেলে উঠেছিলাম। কয়েকদিন থাকার পর পেটের অসুখে ভুগতে হয়। তখন বাড়িতে চলে যাই। এরপর আম্মু আমাকে নিয়ে সাবলেট নেয়। তিনি বলেন, একটা কোচিং করছি, সাথে দুইটা টিউশনি। আমি দিনে ১২-১৫ ঘণ্টা পড়ি। মেডিকেলে আমাকে সুযোগ পেতেই হবে।
কোচিং করা এমন বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সমস্যার অন্ত নেই। তারা গাদাগাদি করে থাকছেন হোস্টেলে। খাবারের মান নিয়েও আছে সন্দেহ।
বিজ্ঞাপন
আলিফ হাসান থাকেন শুক্রাবাদে। তিনি বলেন, যে ডাল দেয় তা পানি বলেও চালিয়ে দেয়া যাবে। আর যে মুরগির মাংস দেয়, তাতে মাংস বায়োস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হয়।
তারপরও এসব শিক্ষার্থীর পেছনে অভিভাবকদের খরচ নেহায়েত কম নয়। কোচিংয়ের জন্য শিক্ষার্থী প্রতি খরচ ১২-১৫ হাজার টাকার মতো। আর প্রতি মাসে থাকা-খাওয়ার পেছনে খরচ ৮-১২ হাজার টাকা।
রংপুর থেকে ছেলেকে কোচিং করতে পাঠিয়েছেন স্কুলশিক্ষক সাজেদুল হাকিম। তিনি বলেন, ছেলেটা এসএসসি-এইচএসসি দুটোতেই জিপিএ-৫ পেয়েছে। এখন একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারলেই বাঁচি। এই সময়টার জন্য আমি এক লাখ টাকা বাজেট রেখেছি। এখন এই টাকায় সব হলেই হয়।
তবে ঢাকায় এসে যে সবাই লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত তা নয়। অনেকেই হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতা কিংবা নতুন শহরে এসে বেঁকে বসেছেন। পড়ালেখা বাদ দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন কুপথে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি জানি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাব না। তাই চেষ্টাও করছি না। কদিন বাদে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাব।
আবার অনেকেই নেশার রাজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, আমার বাড়ি বগুড়ায়। সেখানে অনেক নেশা জাতীয় দ্রব্য পাওয়া যেত না। আবার বাড়িতে থাকার কারণেও নেয়া সম্ভব হতো না। এখন এই অসুবিধা নেই। প্রায় প্রতি রাতেই বসে আসর।
আবার বাড়ির বাইরে এসে অনেকেই সময় পার করছেন প্রেমিক-প্রেমিকার সাথে। এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের সম্পর্ক প্রায় আড়াই বছরের। বাড়িতে থাকার কারণে দেখা করতে পারতাম না, সময় কাটাতে পারতাম না একসাথে। এখন যেহেতু এলাকার বাইরে, তাই সময়টাকে কাজে লাগাচ্ছি। পড়াশুনাও করছি।
সম্প্রতি প্রকাশিত এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাস করেছেন ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ জন শিক্ষার্থী। পাসের হার ৮৫.৯৫ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন।
সবার জন্য উচ্চশিক্ষায় আসন মিললেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় মিলে ভর্তির সুযোগ পাবেন ৮০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী। ফলে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যেও প্রায় লাখ খানেক বঞ্চিত হবেন পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোয় আসন রয়েছে পাঁচ লাখের বেশি। পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসনসহ দেশে উচ্চ শিক্ষায় আসন রয়েছে প্রায় ১৩ লাখ। ফলে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির সুযোগ পাবেন সবাই।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আসন রয়েছে ৬০ হাজারের বেশি। মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আসন প্রায় ১৮ হাজার। সবমিলিয়ে ৫১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন প্রায় ৮০ হাজার। ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ৪ হাজার ৩৫০ ও বেসরকারি ৭২টি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৪৮৯টি আসন রয়েছে।
এছাড়া চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ৭২০, ছয় টেক্সটাইল কলেজে ৭২০, সরকারি ও বেসরকারি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি প্রতিষ্ঠানে আসন আছে ৫ হাজার ৬০০। আর ১৪টি মেরিন অ্যান্ড অ্যারোনটিক্যাল কলেজে ৬৫৪টি আসন রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন প্রায় সাগে ৫ লাখ। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন রয়েছে প্রায় ১ লাখ ৮৪ হাজার।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য ড. মুহাম্মদ আলমগীর ঢাকা মেইলকে বলেন, প্রতিযোগিতা আছে। তবে দেশের উচ্চশিক্ষায় পর্যাপ্ত আসন রয়েছে। গত বছরের মতো এ বছরও সঙ্কট নেই। বরং ১৩ লাখ আসনের বিপরীতে কয়েক লাখ আসন ফাঁকা থাকবে।
৮ ফেব্রুয়ারি এইচএসসির ফল প্রকাশের পর শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, এবারও গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুরোধ করব যে এইচএসসি সিলেবাসে পরীক্ষা হয়েছে সে সিলেবাসে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হোক। একই বিষয়ে বার বার পরীক্ষা হওয়া উচিত না। যেমন ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা, গণিত বা ইংরেজি বিষয়ে নির্দিষ্ট নম্বরে পরীক্ষা হওয়া উচিত। আমরা চাই একটাই পরীক্ষা হোক। যতদিন না হয় ততদিন চলমান গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষাটা আরও কীভাবে ভালো করা যায় তার জন্য কাজ করতে হবে।
পিএস/জেএম