বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সংগীত নাকি ধর্মীয় শিক্ষক, প্রাথমিকে টানাটানি

মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)
প্রকাশিত: ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:১৭ পিএম

শেয়ার করুন:

সংগীত নাকি ধর্মীয় শিক্ষক, প্রাথমিকে টানাটানি
সংগীত নাকি ধর্মীয় শিক্ষক, প্রাথমিকে টানাটানি

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগের পর থেকে নানা আলোচনা ও সমালোচনা শুরু হয়েছে। এই শিক্ষক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে এর বিরোধিতা করে আসছে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো। এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেছে তারা। তাদের দাবি, ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে কোন স্বার্থে সংগীতের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। দেশের বেশির ভাগ পরিবার চায় তাদের সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দিতে, কিন্তু নিয়োগ দেওয়া হবে সংগীত শিক্ষক। সংগীত শিক্ষকের বদলে ধর্ম শিক্ষক নিয়োগের দাবিও জানিয়ে আসছে তারা।

এদিকে শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষা হওয়া উচিত ইনক্লুসিভ। শিশুদের সংস্কৃতি চর্চার জন্য সংগীতের শিক্ষক প্রয়োজন। কারণ সংগীত এমন একটা জিনিস, এ ব্যাপারে দক্ষ না হলে সেটি শেখানো সম্ভব নয়। এছাড়া শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অভিভাবকরা।


বিজ্ঞাপন


সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২০ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব তৈরি করে। এর ভিত্তিতে গত বছর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই দুই বিষয়ে ৫ হাজার ১৬৬ জন শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাবে সম্মতি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সংগীতের জন্য ২ হাজার ৫৮৩ জন এবং শারীরিক শিক্ষার ২ হাজার ৫৮৩ জন। এরপর গত ২৮ আগস্ট ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’–এর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে অন্যান্য বিষয়বস্তুর পাশাপাশি সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ রয়েছে।

যেভাবে পরিচালিত হয় প্রাথমিক শিক্ষা

দেশের ৬৫ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে পড়ানো হয়। আর তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ছয়টি বিষয় পড়ানো হয়। বিষয়গুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, প্রাথমিক বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বাংলা এবং নিজ নিজ ধর্ম শিক্ষা।

5


বিজ্ঞাপন


প্রাথমিকে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ হয় না। প্রত্যেক শিক্ষকই সব বিষয় পড়ান। তবে কয়েক বছর ধরে ২০ শতাংশ পদ বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে। মূলত বিজ্ঞান ও গণিতে দক্ষতা বাড়াতেই এই পদক্ষেপ। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সংগীতের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের আলাদা পাঠ্যপুস্তক নেই। শিক্ষার্থীদের সংগীত বিষয়ে কোনো পরীক্ষা দিতে না হলেও বছর শেষে শিক্ষকেরা তাদের মূল্যায়ন করেন। এজন্য শিক্ষক নির্দেশিকা দেওয়া আছে।

নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ‘বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত যেসব সংগীত রাখা হয়েছে, সেগুলো শিক্ষার্থীরা আত্মস্থ করতে পারলে তাদের মধ্যে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের চেতনা, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শ্রমের প্রতি মর্যাদা ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হবে। শিক্ষার্থীর ভর্তির হার বাড়বে, ঝরে পড়া কমবে।’

ইসলামি দলগুলো যা বলছে

শিক্ষক নিয়োগের নতুন নীতিমালা প্রকাশের পর থেকে ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলো এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক সেমিনারে জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক পাঁচটি দলের নেতারা বলেন, লেখাপড়ার মানের অবনতি ঘটায় শিক্ষার্থীদের মানসিক ও আদর্শিক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সরকার সেদিকে লক্ষ না করে গানের শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে। সংগীত শিক্ষকের জায়গায় সরকারকে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। তা না হলে দেশের ইসলামপ্রেমী জনগণ রাজপথে নামতে বাধ্য হবেন।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রাথমিক শিক্ষায় ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতমূলক করার দাবিতে সর্বদলীয় ইসলামী শিক্ষা রক্ষা জাতীয় কমিটি সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে সঙ্গীত শিক্ষকের জায়গায় সরকারকে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। এর ব্যতিক্রম হলে দেশের জনগণকে সাথে নিয়ে রাজপথে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।

6

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা ইউনূস আহমদ বলেন, আমরা চাচ্ছি ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হোক। কারণ এটির মাধ্যমে শিশুরা নীতি-নৈতিকতা আরও ভালো করে শিখতে পারবে। শিশুদের এই গুণ শেখানো খুবই জরুরি। আসলে কোনো ধর্মে কিন্তু নৈতিকতা বিরোধী কিছু শেখানো হয় না। ফলে প্রাথমিক স্তরে সব ধরনের ধর্মীয় শিক্ষক থাকা জরুরি। এছাড়া দেশের অধিকাংশ অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে ধর্মীয় মূল্যেবোধে বিশ্বাসী করতে চায়। এটি প্রাথমিক স্তরে সেভাবে দেওয়া হয় না বলে অনেকে সন্তানদের মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। তাই প্রাথমিকে শিক্ষার্থী বিমুখ হওয়ার প্রবণতাও কমে আসবে যদি ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।
 
কী বলছেন বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক ও অভিভাবকরা

দেশের শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ইনক্লুসিভ রাখা উচিত। তবে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অভিভাবকরা। কেউ কেউ মনে করেন, গানের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষক নিয়োগ করা উচিত। আবার কারও কারও মতে এর প্রয়োজন নেই। বরং ধর্মীয় শিক্ষার জন্য স্বতন্ত্র পদ সৃষ্টি করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হোক।

আলমগীর হোসেন নামের একজন অভিভাবেক বলেন, আসলে বাচ্চাদের সব কিছু শেখা জরুরি। কোন শিক্ষক আসলে কী শেখাবে তার চেয়ে বেশি জরুরি শিক্ষার্থীরা কত বেশি জানাতে পারছে। শিশুদের ক্ষেত্রে সব বিষয় অল্প করে জানাশোনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই সংগীতের ক্ষেত্রে দক্ষ মানুষজন ভালো ভূমিকা রাখতে পারবে। যে কেউ চাইলে সংগীত শেখাতে পারে না।

নেত্রকোণার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহিম। তিনি বলেন, দেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান, তাই আমাদের স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষক নেওয়া দরকার। এতে শিক্ষার্থীদের আরও ভালোভাবে ধর্মীয় বিষয়গুলো বোঝানো সম্ভব হবে।

তবে বিপরীত মতামত প্রকাশ করেছেন নওগাঁ জেলার একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি বলেন, আসলে স্কুলের বাচ্চাদের ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দিতে পারবেন সব শিক্ষকই। কারণ প্রাথমিক স্তরে খুবই সাধারণ ধর্মীয় ব্যাপারগুলো শিশুদের শেখানো হয়। তবে শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য সংগীত ও কলার ব্যাপারে জ্ঞান দেওয়া খুবই জরুরি। এসব বিষয় এমন যে অন্য কোনো শিক্ষক চাইলেও এসব বিষয় শেখাতে পারবেন না। ফলে সংগীতের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া জরুরি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠপুস্তক বোর্ডের শীর্ষ এক সম্পাদক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘শিক্ষা কারিকুলাম সম্পূর্ণ ইনক্লুসিভ হওয়া উচিত। কোনো এক ধর্ম বা জাতি-গোষ্ঠীর কোনো বিষয়ে প্রধান্য দেওয়া অনুচিত। শিশুদের বিকাশের ক্ষেত্রে সংগীত, কলা, শিল্প এসব জরুরি। আর এসব শেখানো জন্য বিশেষভাবে দক্ষ শিক্ষক প্রয়োজন। এছাড়া ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তবে বাকিগুলোকে বাদ দিয়ে নয়।’

প্রাথমিক শিক্ষা সংস্কার কমিটির প্রধান ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অনেকেই বিভিন্ন ধরনের মতামত দিতে পারেন। তবে সবার মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। সরকারের শিক্ষানীতি এবং প্রাথমিক শিক্ষা সংস্কার কমিটির সুপারিশ অনুসারে একটা টেকসই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ শুধু বিভিন্ন সময় ছোট ছোট প্রশ্ন আসবে আর সেগুলো আমলারা ঠিক করবে, তাতে টেকসই কিছু সম্ভব নয়।’

এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘প্রাথমিক স্তরে যে ধরনের ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হয় সেটির জন্য বিশেষভাবে শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন নেই। কারণ এই পর্যায়ের শিক্ষাদান অন্য শিক্ষকদের দায়িত্ব দিয়েও কাজ করা সম্ভব। আর প্রতিটি ধর্ম অনুসারে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়াও সম্ভব নয়। এদিকে সংগীত শেখানোর জন্য প্রয়োজন এই বিষয়ে দক্ষ শিক্ষক। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে বইসহ আরও অনেক কিছু জরুরি।’

এএসএল/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর