শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সংকট পিছু ছাড়ছে না ৭ কলেজের!

মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)
প্রকাশিত: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:৩৪ পিএম

শেয়ার করুন:

collage
সংকট কাটছে না ঢাকার সরকারি সাত কলেজের। ছবি: সংগৃহীত

গত সাত বছর ধরে রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের অস্থিরতা যেন কাটছেই না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সব কলেজ নিয়ে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ নামে ভর্তি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে হঠাৎ করে বেঁকে বসেছেন এসব কলেজের শিক্ষক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। এতে ত্রিমুখি সংকটে পড়েছে প্রস্তাবিত এই বিশ্ববিদ্যালয়।

নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ এগিয়ে নিতে অনেক শিক্ষক শুরুতে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে তারা ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে সরে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। শিক্ষকদের দাবি, যে প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হচ্ছে এতে কলেজগুলো স্বতন্ত্র ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। পাশাপাশি তৈরি হবে নানা সংকট। শিক্ষার্থী ভর্তি কম নেওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষাও সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। এছাড়া বিসিএস ক্যাডারের পদও বিলুপ্ত হতে পারে বলে শঙ্কা করেছেন তারা।


বিজ্ঞাপন


সাতটি কলেজের মধ্যে পাঁচটিতে স্নাতক ও স্নাতকত্তোরের পাশাপাশি উচ্চমাধ্যমিকে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ফলে এসব কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা জানান, এভাবে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হলে অনেকের জন্য সমস্যা হবে। যার মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ভর্তি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে ঢাকার অন্য বেসরকারি কলেজে চাপ বাড়বে এবং অর্থনৈতিকভাবে বিভিন্ন পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অন্যদিকে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে আগে থেকে আন্দোলন করে আসছেন কলেজগুলোর স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী।

ত্রিমুখি সংকট


বিজ্ঞাপন


ত্রিমুখি সংকটের প্রথমে রয়েছেন কলেজগুলোর শিক্ষকরা। যারা বর্তমানে প্রস্তাবিত কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। দ্বিতীয় সংকট হচ্ছে, পাঁচটি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়ারা ইতোমধ্যে আন্দোলন শুরু করেছেন। আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন সাত কলেজের স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা, যারা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছেন।

Collage2
নানা দাবিতে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

সংকটের শুরু যেভাবে

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে বাদ দিয়ে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সরকারি সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. হারুন অর রশীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফীন সিদ্দিকের দ্বন্দ্ব ছিল। মূলত এই দ্বন্দ্বের বলি হয়েছেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।

তবে যে লক্ষ্য নিয়ে এই অধিভুক্ত করা হয়েছিল তা পূরণ হয়নি। বরং তৈরি হয় নানা জটিলতা। অধিভুক্তির পর ঠিক সময়ে পরীক্ষা নেওয়া, ফল প্রকাশ, হয়রানি বন্ধ, পড়াশোনার খরচ কমানোসহ বিভিন্ন দাবিতে নানা সময়ে আন্দোলন করেন এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের দীর্ঘ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধিভুক্তি বাতিল করে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির অধ্যাদেশ খসড়া হলেও সংকট কাটেনি। গত ২৪ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের ওয়েবসাইটে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অধ্যাদেশ, ২০২৫’ শিরোনামে এই খসড়া প্রকাশ করা হয়। এছাড়া যেকোনো অভিযোগ ও পরামর্শের জন্য মতামতও চাওয়া হয়েছে।

সরকারি এই সাতটি কলেজ হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ।

আরও পড়ুন

শিক্ষকদের এত আন্দোলন কেন?

মৌলিক শিক্ষায় ৮ ধারার বিভাজন, ‘জাতীয় ঐক্যে’ সংকট

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে চারটি প্রধান স্কুল বা অনুষদ। সায়েন্স, আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ, বিজনেস স্টাডিজ এবং ল অ্যান্ড জাস্টিস। শিক্ষা কার্যক্রম হবে হাইব্রিড পদ্ধতিতে। ৪০ শতাংশ ক্লাস অনলাইনে ও ৬০ শতাংশ অফলাইনে। তবে সব পরীক্ষা সশরীরে দিতে হবে শিক্ষার্থীদের। স্নাতক পর্যায়ের ২৩টি বিষয়ের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৪০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবেন। একেকটি কলেজে একেকটি অনুষদ বা একাধিক বিভাগ থাকবে।

যেভাবে চলবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়

প্রস্তাবিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুধু দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চলবে। প্রথম চার সেমিস্টার সাধারণ বিষয়, পরের চারটি ডিসিপ্লিনভিত্তিক। চারটি সেমিস্টার শেষ করার পর শর্ত পূরণসাপেক্ষে শুধু নিজ ক্যাম্পাসে ডিসিপ্লিন পরিবর্তনের সুযোগ পাবেন শিক্ষার্থীরা।

এই সাতটি কলেজের অবকাঠামো ও ক্যাম্পাস স্থায়ীভাবে দিনের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (বেলা একটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত) ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। যেসব কলেজে এখন উচ্চ মাধ্যমিক স্তর আছে, সেগুলো অক্ষুণ্ন থাকবে। এছাড়া সার্চ কমিটির মাধ্যমে উপাচার্য ও সহ–উপাচার্য নিয়োগ হবে। প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক, সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ও ইমেরিটাস অধ্যাপকের পদসহ গবেষক ও কর্মচারীর যেকোনো পদ সৃষ্টি করা যাবে। তবে বিদ্যমান শিক্ষকদের বিষয়ে অধ্যাদেশে পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়নি।

শিক্ষকদের বিরোধিতার কারণ

প্রস্তাবিত কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির বিরুদ্ধে সাতটি কলেজের শিক্ষকরা একযোগে মানববন্ধন করেছেন। এছাড়া শিক্ষকরা ১১ দফা দাবি জানিয়েছেন। সেগুলো হলো- কলেজের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি কলেজের নামে অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে; তা বিশ্ববিদ্যালয় নামে হস্তান্তর করা যাবে না; বিদ্যালয়ের (কলেজগুলোর) কার্যক্রম, পাঠদান ও অবকাঠামোর গুরুত্ব বিবেচনায় এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস অবশ্যই পৃথক স্থানে হতে হবে, অর্থাৎ সেটা কলেজ ক্যাম্পাসে ভাড়া ভিত্তিতে চালানো যাবে না; প্রস্তাবিত ‘পরীক্ষামূলক বিশ্ববিদ্যালয় মডেল’ (যা কলেজগুলোর সব বিষয় এক সময়ে চলবে না) চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।

Collage3
রাজধানীর সরকারি সাতটি কলেজ। ছবি: সংগৃহীত

সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কলেজ শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি রাহাত ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কোনো আলোচনা ছাড়াই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল এই সাত কলেজ। অধিভুক্তের সময় নানা সমস্যা ও সংকটের কবলে পড়ে এসব কলেজ। পরবর্তী সময়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি করি। এই প্রস্তাবে সরকার সাড়া দিলেও ইউজিসি চরম অগণতান্ত্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির খসড়া করেছে। তাই এমন সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা চাই দ্রুত এসব কলেজের বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করে নতুনভাবে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির অধ্যাদেশ করা হোক। এটি করলেই কেবল সংকট কাটতে পারে।’

আরও পড়ুন

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের নামে ৮০০ কোটি টাকার বাণিজ্য!

‘মানসিক চাপে’ ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসক ও বর্তমান ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমানে বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন। এসব বিষয় মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কাজ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।’

প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা অসংখ্য সভা করে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো তৈরি করেছি। এখানে কোনো কিছু লুকানো নেই। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর বিষয়ে যেকোনো অভিযোগ ও পরামর্শ দিতে সবার কাছে আহ্বানও করা হয়েছে।’

এএসএল/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর