- ৩৫ বছরে চারবার নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন
- নির্বাচন ব্যাহত করার ষড়যন্ত্র দেখছেন শিক্ষার্থীরা
- পরিবেশ সুষ্ঠু করতে সচেষ্ট শিবির-ছাত্রদলের প্রার্থীরা
- নির্বাচন আদৌ হবে কি না সন্দিহান অনেকেই
- ১৬ অক্টোবরই ভোট হবে: প্রধান নির্বাচন কমিশনার
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন ২৫ সেপ্টেম্বর হওয়ার কথা থাকলেও তা স্থগিত হয়ে যায়। আগামী ১৬ অক্টোবর নির্বাচনের নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের একাংশ মনে করছে, এই তারিখ নিয়েও অনিশ্চয়তা কাটেনি। এর আগে একাধিকবার তারিখ পরিবর্তন হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি সাম্প্রতিক ক্যাম্পাস অস্থিরতা ও আন্দোলনের ঘটনাকে ঘিরে আবারও নির্বাচনি আয়োজন স্থগিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, শিক্ষকরা পেট কোটা পুনঃস্থাপনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে ২০ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থীরা এক দিনের পূর্ণ বন্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরদিন থেকে কর্মকর্তারা ‘সর্বাত্মক শাটডাউন’ ঘোষণা করেন। এর পাশাপাশি শিক্ষকরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি চালাচ্ছেন। ফলে ২৫ সেপ্টেম্বরের পরিবতর্তে ১৬ অক্টোবর ভোটের তারিখ ধার্য করা হয়।
গত বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) কর্মকর্তারা সাত দিনের আলটিমেটামের সঙ্গে ‘সর্বাত্মক শাটডাউন’ স্থগিত করেছেন। তবে ন্যাশনালিস্ট শিক্ষক ফোরাম এখনো ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের প্রোগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে কিছু নির্বাচনি প্যানেল, যেমন ছাত্রশিবির, এই নির্বাচন স্থগিতের প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ১৬ অক্টোবরের নির্বাচন আদৌ হবে কি না সেটা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।
সূত্র বলছে, ৩৫ বছর ধরে রাকসু নির্বাচন হচ্ছে না। এই নির্বাচন বিভিন্ন সময় বারবার ব্যাহত হয়েছে। মোট চারবার নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তিত হয়েছে এবং সাতবার সময়সূচি পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। কখনো শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের আন্দোলন, কখনো ছাত্রদলের কর্মসূচি এবং সর্বশেষে পেট কোটা নিয়ে উত্তেজনা ভোটের পরিবেশকে কঠিন করে তুলেছে। কিছু শিক্ষক ও শিক্ষার্থী মনে করছেন, পেট কোটা পুনঃপ্রবর্তন ইস্যুটি নির্বাচনের আগে উঠে আসা একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এক পক্ষ রাকসুতে নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়, অন্য পক্ষ নির্বাচনের কার্যক্রম ব্যাহত করতে চায়।
বিজ্ঞাপন
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশাসন ও শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাত দিনের আলটিমেটাম স্থগিত হলেও ন্যাশনালিস্ট শিক্ষকরা এখনো ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করছেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে যে, ১৬ অক্টোবরের নির্বাচন সম্ভব হবে কি না। তারা জানান, নির্বাচনের আগে পেট কোটা ইস্যু আনা হয়েছিল। এটি এক পক্ষের উদ্দেশ্য রাকসুকে একপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণে নেওয়া। নির্বাচন স্থগিত হওয়ার পর আবারও একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তাই নির্বাচন সফল হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা আছে।
শিক্ষকরা বলছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাকসু নির্বাচন ৩৫ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তবে নানা জটিলতা ও আন্দোলনের কারণে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। শিক্ষার্থী ও প্রার্থী, শিক্ষক ও প্রশাসন—সকলেই প্রত্যাশা করছেন যে, ১৬ অক্টোবরের মধ্যে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে শিক্ষার্থী ও নির্বাচনি পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে নির্বাচন পরিবেশের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে।
অন্যদিকে আন্দোলনরত শিক্ষকরা বলছেন, রাকসু নির্বাচনের সঙ্গে তাদের আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রথম বর্ষের ক্লাস প্রায় এক মাস ধরে চললেও সন্তানদের ভর্তি প্রক্রিয়ার স্থগিত থাকার কারণে এই প্রোগ্রাম চালানো হচ্ছে। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে পেট কোটা কার্যকর রয়েছে, কেন তা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধ হবে।
ন্যাশনালিস্ট শিক্ষক ফোরামের সভাপতি প্রফেসর ড. আব্দুল আলিম ঢাকা মেইলকে বলেন, তাদের কখনো রাকসুর বিরোধী উদ্দেশ্য ছিল না। তাদের এক দাবি মেনে নেওয়ায় প্রোগ্রাম স্থগিত করা হয়েছে। তবে উপ-উপাচার্যের ওপর হামলার পর পুনরায় প্রোগ্রাম চালাতে হয়েছে।
নির্বাচনি প্যানেল ও প্রার্থীরাও তাদের দিক তুলে ধরেছেন। ছাত্রশিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সচিব মুজাহিদ ফয়সল ঢাকা মেইলকে বলেন, পেট কোটা ইস্যু নির্বাচনের আগে উত্থাপিত হয়েছে এবং এটি এক পক্ষের নির্বাচনী ষড়যন্ত্রের অংশ। চট্টগ্রামভিত্তিক ছাত্রদলসহ অন্যান্য প্রার্থী এটি রোধ করতে চেয়েছে। তবে নির্বাচন স্থগিত হওয়ার পেছনে মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনি পরিবেশকে ব্যাহত করা।
ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবির ঢাকা মেইলকে জানান, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করার চেষ্টা থেকে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে চাইছে। তবে পেট কোটা পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে আবারও নির্বাচনি পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করা হচ্ছে।
স্বতন্ত্র সিনেট সদস্য প্রার্থী মনির হোসেন মাহিন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা সন্দিহান—এই নির্বাচন আদৌ হবে কি না। এর আগে দুই-তিনবার তারিখ পরিবর্তন হয়েছে, এবারও শেষ মুহূর্তে পরিবর্তন হলো।
এই প্রার্থী বলেন, নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা নেই, কারণ তারা নিজেদের নিয়ম মানতে পারছে না। কখনো দলের চাপ, কখনো অন্য কারণে তারিখ পাল্টাচ্ছে। আমাদের কাছে তারা মেরুদণ্ডহীন বলেই মনে হয়।
তিনি আরও বলেন, একবার তারিখ নির্ধারণ হলে সেটা দৃঢ়ভাবে বজায় রাখা উচিত ছিল। এখন অক্টোবরের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা দেখতে চাই, তারা অক্টোবরেই নির্বাচন দিতে পারে কি না।
সোশ্যালিস্ট স্টুডেন্ট ফ্রন্টের কনভিনার ফুয়াদ রতুল ঢাকা মেইলকে বলেন, এক পক্ষ রাকসু নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়, অন্য পক্ষ নির্বাচনের কার্যক্রম ব্যাহত করতে চায়। পূর্বে সমাধান হওয়া পেট কোটা ইস্যু আবার সামনে আনার ফলে নির্বাচন পরিস্থিতি নষ্ট হয়েছে।
ইউনিভার্সাল স্টুডেন্টস পার্লামেন্ট প্যানেলের ভিপি প্রার্থী তাসিন খান ঢাকা মেইলকে বলেন, তারা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। তবে পূর্বে সমাধান হওয়া ইস্যু নিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। এটি আগে সমাধান করা প্রয়োজন।
এন্টি-হেজেমনিক ইউনিটি প্যানেলের জিএস প্রার্থী সালাহউদ্দিন আম্মার ঢাকা মেইলকে বলেন, পেট কোটা এক বছর আগে বাতিল করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে এটি আবার সামনে আনা হয়েছে এবং একটি সংকট সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বাড়িতে ফিরে গেছে এবং প্রশাসনকে নির্বাচন স্থগিত করতে হয়েছে। এটি স্পষ্টত একটি পরিকল্পিত পরিস্থিতি।
শিক্ষকদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষক অধ্যাপক কামরুল আহসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রথম বর্ষের ক্লাস প্রায় এক মাস আগে শুরু হয়েছে। কিন্তু আমাদের দীর্ঘদিনের দাবিসংক্রান্ত কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রশাসন থেকে জানানো হয়নি। এই কারণে আমাদের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়ছিল। তাই আমরা আমাদের কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছি। তবে এটিকে ভুলভাবে দেখা উচিত নয়—আমাদের শিক্ষার্থীদের রাকসু নির্বাচন বা তাদের স্বার্থের সঙ্গে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। আমরা চাইছি, শিক্ষার্থীরা যাতে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে পারে। পাশাপাশি আমরা নির্বাচন কমিশনকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি এবং আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়েছে।’
অন্যদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. এফ. নজরুল ইসলাম আশার বার্তা দিয়েছেন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নির্বাচনের তারিখ ও তফসিল কয়েক বার পরিবর্তিত হয়েছে। সর্বশেষ তারিখ পরিবর্তনের কারণ ছিল নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকা। নির্বাচন পরিবেশকে ব্যাহত করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরাও কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। তবে যেকোনো পরিস্থিতিতেই আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী যে, নৌকা শেষ পর্যন্ত তীরে পৌঁছাবে। রাকসু নির্বাচন অবশ্যই অনুষ্ঠিত হবে। আমরা দৃঢ়ভাবে আশা করছি, আগামী ১৬ অক্টোবর শিক্ষার্থীরা কোনো সহিংসতার আশ্রয় না নিয়ে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি আমরা শিক্ষকদের, কর্মকর্তাদের এবং কর্মচারীদের কাছ থেকেও সর্বোচ্চ সহযোগিতা আশা করছি, যাতে একটি সুন্দর ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করা যায়।’
এএইচ/জেবি

